পোশাক শিল্পে কর্মসংস্থান সংকট, ১৫ মাসে বন্ধ ১১৩, খুলেছে ১২৮ কারখানা

বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানিনির্ভর খাত তৈরি পোশাক শিল্প (RMG) বর্তমানে এক ধরনের মিশ্র বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গত ১৫ মাসে নতুন ১২৮টি কারখানা স্থাপিত হলেও একই সময়ে ১১৩টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এই প্রক্রিয়ায় মোট বেকার হয়েছেন প্রায় ২২ হাজার পোশাক শ্রমিক। তবে এ পরিস্থিতিকে অনেক শিল্পপতি স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির একটি অংশ হিসেবে দেখছেন।
বিনিয়োগ ও ছাঁটাই—একসঙ্গে এগোচ্ছে পোশাক খাত
বিজিএমইএ (বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি) সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে তাদের নতুন সদস্য হিসেবে যুক্ত হয়েছে ১২৮টি পোশাক কারখানা। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৭৪ হাজার মানুষের। তবে একই সময়ে বন্ধ হওয়া ১১৩টি কারখানায় কর্মরত ছিলেন প্রায় ৯৬ হাজার ১০৪ শ্রমিক, যাদের অনেকে নতুন চাকরির সুযোগ না পেয়ে এখনো বেকার।
কেন বন্ধ হচ্ছে কারখানাগুলো?
গত আগস্ট থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে বন্ধ হওয়া ৬৯টি কারখানার মধ্যে বেশিরভাগই ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান। বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল জানিয়েছেন, “রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রভাব, ব্যবসায়িক খরচের উর্ধ্বগতি এবং প্রতিযোগিতামূলক চাপে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকতে পারছে না।”
এছাড়া বৈশ্বিক বাজারে চাহিদা কমে যাওয়া, অর্ডারের অনিশ্চয়তা, বৈদেশিক মুদ্রার ওঠানামা এবং কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিও অনেক প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সংকটে ফেলেছে। এর প্রভাব পড়ছে শ্রমবাজারেও।
বেক্সিমকোর ২৪টি কারখানা বন্ধ
সবচেয়ে আলোচিত বন্ধ হওয়া কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপের ২৪টি কারখানা। যদিও এর কিছু প্রতিষ্ঠান আগে থেকেই কার্যত অকার্যকর ছিল। ২০২৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বেক্সিমকোর শিল্পপার্কের ১৪টি কারখানা একসঙ্গে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এতে প্রায় ৩৩ হাজার শ্রমিক একসঙ্গে কর্মহীন হয়ে পড়েন।
এছাড়া কেয়া গ্রুপ, টিএনজেড, ভারগো এমএইচ, সিরোক অ্যাপারেলস, মডিশ অ্যাটায়ার ও ওডিশ ক্র্যাফট-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও একই সময়ে উৎপাদন বন্ধ করে দেয়।
নতুন কারখানাগুলো কারা?
পোশাক খাতে নতুন বিনিয়োগের বিষয়টি একেবারেই উপেক্ষণীয় নয়। নতুন যুক্ত হওয়া ১২৮টি কারখানার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:
- AKH Outwear
- AZ Composite (গাজীপুরে পরীক্ষামূলক উৎপাদন)
- Nexton
- LSA Apparels
- Citech Fashion
- Supreme Outfit
- Sparrow Greentech
তবে এই কারখানাগুলোর বেশিরভাগই ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের। মাত্র ১৮টি কারখানায় শ্রমিকসংখ্যা ১ হাজারের বেশি। AZ Composite-এর মতো কারখানায় বর্তমানে মাত্র ১৫০ জন শ্রমিক রয়েছে। তবে পূর্ণ উৎপাদনে গেলে কর্মসংস্থান ৭০০-৮০০ জনে পৌঁছাতে পারে।
প্রযুক্তি ও আধুনিকায়নে বিনিয়োগ
বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান মনে করেন, “কারখানা খোলা এবং বন্ধ হওয়া একটি চলমান প্রক্রিয়া। বিশ্বজুড়ে এমন ঘটনা ঘটে থাকে।” তবে তিনি এটাও বলেন যে, আধুনিক প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), অটোমেশন ইত্যাদিতে বিনিয়োগ করে অনেক বড় ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান এখনো উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াচ্ছে।
এই আধুনিকায়নের ফলে কিছু জায়গায় শ্রমিকের প্রয়োজন কমে গেলেও দক্ষ শ্রমিক চাহিদা বাড়ছে।
রপ্তানি বাড়লেও বিনিয়োগে সতর্কতা
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (EPB)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ২৫ কোটি মার্কিন ডলার। এটি আগের বছরের তুলনায় ১০.৮৪ শতাংশ বেশি।
তবে যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বিদেশি পণ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপ করায় অনেক উদ্যোক্তা এখন নতুন বিনিয়োগের ব্যাপারে কিছুটা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন।
সংকট না, পরিবর্তনের সময়?
গার্মেন্টস খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন প্রযুক্তি, চাহিদার পরিবর্তন, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাব মিলে খাতটি একটি রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যেখানে ক্ষুদ্র ও অপ্রতিযোগিতামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো ছাঁটাই হচ্ছে, আর বড় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রযুক্তি নির্ভর ও দক্ষতাভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের জন্য এটি এক ধরনের চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনার যুগপৎ সময়। একদিকে ছাঁটাই, বেকারত্ব ও প্রতিষ্ঠান বন্ধ হচ্ছে, অন্যদিকে প্রযুক্তিনির্ভর নতুন প্রতিষ্ঠান ও কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি হচ্ছে। এই বাস্তবতায় শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়ন, কারখানা ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতা, এবং রাষ্ট্রীয় নীতির স্থিতিশীলতা— এগুলোই খাতটির ভবিষ্যত নির্ধারণ করবে।