টেকসই উন্নয়ন নিয়ে ফাঁকা বুলির অভিযোগ: দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

বাংলাদেশের অর্থনীতির টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি অভিযোগ করেন, অতীতের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেনি এবং অনেক ক্ষেত্রে নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিরা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থেকেও টেকসই উন্নয়নের কথা বলেছেন, যা অনেকটাই ফাঁকা বুলির মতো।
আজ মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত ‘জাতীয় এসডিজি প্রতিবেদন ও ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের ভাবনা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় এ মন্তব্য করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। উক্ত আলোচনা সভার আয়োজন করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সভাটি সঞ্চালনা করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতি ও রাজনীতি প্রয়োজন
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতি এবং প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে হবে। নতুন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা তখনই সফল হবে, যখন টেকসই অর্থনীতি গড়ে উঠবে।’
তিনি আরও বলেন, দেশে টেকসই উন্নয়নের ধারণার প্রসার ঘটেছে, তবে এই অর্জন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যক্তি খাতের উদ্যোগের ফলে হয়েছে। তা সত্ত্বেও, ব্যক্তি খাতের অবদান অনেক সময় যথাযথভাবে স্বীকৃতি পায় না। তিনি মনে করেন, টেকসই ব্যবস্থার আরও প্রসার ঘটাতে হলে বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করা এবং সরকারি সমর্থন বাড়ানো প্রয়োজন।
উদ্যোক্তা ও প্রতিযোগিতার অভাব
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘যেখানে নির্বাচন নাই, প্রতিযোগিতা নাই, সেখানে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।’ তিনি উল্লেখ করেন, দেশের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর মধ্যেও নির্বাচন হয়নি, ফলে সেখানে প্রতিযোগিতার অভাব দেখা দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যাঁরা প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতৃত্বে ছিলেন, তাঁরা একই সঙ্গে দুর্নীতি করেছেন এবং আবার টেকসই উন্নয়নের কথাও বলেছেন, যা বাস্তবতা থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন।’
ব্যবসার উপযুক্ত পরিবেশ জরুরি
তিনি বলেন, বাংলাদেশে টেকসই ব্যবসা মডেলের বিকাশের জন্য ব্যবসার উপযুক্ত পরিবেশ থাকা অত্যন্ত জরুরি। এ ক্ষেত্রে অর্থায়ন সমস্যা, জ্বালানি সরবরাহের সংকট, সরকারি সংস্থার হয়রানি এবং শ্রম পরিস্থিতির উন্নতি করা অপরিহার্য।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, ‘সরকারের নীতিনির্ধারকরা সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) সম্পর্কে খুব বেশি জানেন না। সিএসআর সম্পর্কে সরকারি লোকজনেরও ধারণা থাকা দরকার।’
এসডিজি অর্জনে ব্যক্তি খাতের ভূমিকা
আলোচনা সভায় সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে সরকারি-বেসরকারি উভয় পক্ষের সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। তিনি বলেন, ‘এসডিজি অর্জনে ব্যক্তি খাতের বড় ভূমিকা রয়েছে। ব্যক্তি খাতের উন্নয়ন ছাড়া এসডিজি অর্জন সম্ভব নয়।’
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে শুধু তৈরি পোশাক খাত টেকসই উৎপাদনে গুরুত্ব দিচ্ছে, কিন্তু অন্যান্য খাতেরও এই উদ্যোগ নেওয়া উচিত। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) উদ্যোক্তাদের সচেতন করা জরুরি।
জবাবদিহিতা ও ব্র্যান্ডিংয়ের অভাব
নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি মো. ফজলুল হক বলেন, ‘দেশের পোশাক খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করেছে, কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে সেগুলোর স্বীকৃতি তেমন নেই।’
তিনি বলেন, ‘পশ্চিমা ক্রেতারা দায়িত্বশীল উৎপাদন সম্পর্কে সচেতন এবং এর জন্য তারা উপযুক্ত মূল্য পরিশোধেও আগ্রহী। কিন্তু যথাযথ ব্র্যান্ডিংয়ের অভাবে আমরা সেই বাণিজ্যিক সুবিধা পাচ্ছি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এখনো রানা প্লাজা ও তাজরীন ফ্যাশনের ঘটনার কথা শুনতে হয়। অথচ বাংলাদেশে বর্তমানে আড়াইশর বেশি পরিবেশবান্ধব কারখানা রয়েছে।’ তিনি সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
এসডিজি বাস্তবায়নে বিনিয়োগ পরিবেশ
জাতিসংঘ গ্লোবাল কমপ্যাক্ট নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক শাহামিন জামান বলেন, ‘এসডিজি বাস্তবায়নে ব্যক্তি খাতের অবদানকে স্বীকৃতি দিতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, সিএসআরের অর্থ বিভিন্ন খাতে ব্যয় হচ্ছে, তবে এসডিজি অর্জনে এটি কতটা কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা পর্যবেক্ষণ করা জরুরি।
সিটিজেনস প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপ মেম্বার ও নিউ এইজ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ভাইস চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহীম বলেন, ব্যক্তি খাত তিনভাবে এসডিজি অর্থায়নে অবদান রাখতে পারে—সিএসআর থেকে অর্থায়ন, সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ এবং গ্রিন বন্ডের মতো টেকসই অর্থায়নের ব্যবস্থা।
তরুণদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মহাপরিচালক (এসডিজি-বিষয়ক) শিহাব কাদের বলেন, তরুণরা পরিবর্তনের বড় শক্তি এবং ভবিষ্যতে তারাই দেশের নেতৃত্ব দেবে।
ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের করপোরেট অ্যাফেয়ার্স, পার্টনারশিপ ও কমিউনিকেশন পরিচালক শামীমা আক্তার বলেন, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হলে টেকসই ব্যবস্থার বিকল্প নেই। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো দেশে বিনিয়োগ করতে চাইলে তারা টেকসই ব্যবসার পরিবেশ বিবেচনা করে।
উপসংহার
আলোচনা সভায় বক্তারা টেকসই উন্নয়ন অর্জনের জন্য ব্যক্তিখাতের ভূমিকা, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের গুরুত্ব এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজারব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। তারা বলেন, ব্যক্তিখাতের অবদান ছাড়া এসডিজি অর্জন সম্ভব নয় এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা সম্ভব।