কর্মসংস্থান

চা বাগান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ, বিপাকে পাঁচ শতাধিক শ্রমিক

Advertisement

হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার বৈকুন্ডপুর চা বাগান সম্প্রতি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে। শনিবার রাতেই বাগান ব্যবস্থাপকসহ সকল কর্মকর্তা বাগান ত্যাগ করেন এবং বাগান এলাকায় সাইন বোর্ড দিয়ে ঘোষণা দেন যে, চা বাগান সাময়িকভাবে বন্ধ। এ ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় পাঁচ শতাধিক শ্রমিকের কাজ ও জীবিকা মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

চা বাগান বন্ধ ঘোষণার সঙ্গে যুক্ত বেশ কিছু উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। বাগানের ব্যবস্থাপক শামসুদ্দিন হক ভুঁইয়া জীবনের নিরাপত্তার জন্য স্থানীয় থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন। স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, চা শ্রমিকরা হঠাৎ বাগান বন্ধ ঘোষণার কারণে আতঙ্কে পড়েছেন, আর এতে অনেকের ঘরে খাবার সংকট তৈরি হয়েছে।

শ্রমিক ও ম্যানেজারের সংঘর্ষের পেছনের কারণ

পঞ্চায়েত ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ম্যানেজার শামসুল ইসলাম ভূঁইয়া সাম্প্রতিক সময়ে বাগানে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। এতে কিছু শ্রমিক নেতা ও কর্মী ক্ষুব্ধ হয়ে সাধারণ শ্রমিকদের উসকে দেয়।

গত শনিবার সকালে শ্রমিকরা কাজ বন্ধ রাখে এবং বিকেলের দিকে দলবদ্ধ হয়ে ম্যানেজারের বাংলোর সামনে অবস্থান নেয়। অভিযোগ রয়েছে, ম্যানেজারের তত্ত্বাবধানে শ্রমিকদের ঘরের ভাঙা দরজা ও জানালা মেরামতের কাজ হয়নি। সেই সঙ্গে ম্যানেজারের বিরুদ্ধে তিনটি ট্যাক্টর গাছ চুরি করে বিক্রি করার অভিযোগও উঠে।

এই উত্তেজনার মধ্যে, বিকেলে শ্রমিকেরা ম্যানেজারের বাংলোতে হামলা চালিয়ে দুটি দরজা ভেঙে ফেলে এবং ম্যানেজারকে শারীরিক আঘাত করার চেষ্টা করে। তবে ম্যানেজার প্রাণে রক্ষা পান।

ম্যানেজার শামসুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, “বিনা কারণে কিছু শ্রমিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা করলে তারা ক্ষুব্ধ হয়। আজ তারা আমার প্রাণনাশের চেষ্টা করেছে।”

চা বাগান বন্ধ ঘোষণার পর শ্রমিকদের দুর্দশা

বাগান মালিকপক্ষ রোববার থেকে চা বাগান লেঅফ (ছুটি) ঘোষণা করেছেন। এ সিদ্ধান্তের ফলে বাগানে কাজ করা প্রায় পাঁচ শতাধিক শ্রমিক বর্তমানে বেকার হয়ে পড়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকের ঘরে খাবারের অভাব দেখা দিয়েছে।

বাগানের পঞ্চায়েত সভাপতি অনিল ভুমিজ বলেন, “আমরা ম্যানেজারের ওপরে হামলা করি নি। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ম্যানেজার কোনো কথা শোনেননি এবং বাগান বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন প্রায় ৫০০ শ্রমিক কাজ হারিয়ে ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন।”

স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, চা বাগান বন্ধ হওয়ায় শুধু শ্রমিকরাই নয়, পুরো এলাকায় অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। চা বাগানের সঙ্গে যুক্ত ছোট ব্যবসা, দোকানপাট, পরিবহন ও স্থানীয় কৃষকরা সবাই এই বন্ধের প্রভাব সামলাচ্ছেন।

আইনগত পদক্ষেপ ও পুলিশি তদন্ত

মাধবপুর থানার ওসি তদন্ত কবির হোসেন জানিয়েছেন, চা বাগানের ব্যবস্থাপক থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন। পুলিশ বিষয়টি খতিয়ে দেখে আইনগত ব্যবস্থা নেবে।

স্থানীয়রা আশা করছেন, পুলিশ দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনবে এবং শ্রমিকদের কাজের সুযোগ পুনরায় নিশ্চিত করবে। এছাড়া তারা চা বাগান পুনরায় চালুর জন্য প্রশাসনের মধ্যস্থতা চাচ্ছেন।

শ্রমিকদের সমস্যার গভীর প্রভাব

চা বাগান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হওয়ায় শ্রমিকদের জীবিকা একেবারেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। শ্রমিকদের অধিকাংশই গ্রামের গরীব পরিবার থেকে। তারা দৈনিক আয়ের উপর নির্ভরশীল, তাই কাজ বন্ধ থাকলে পরিবারের খাবার, চিকিৎসা এবং শিক্ষার খরচও বিপন্ন হয়।

এক শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমাদের আজকাল রুটি জোগাড় করতেও সমস্যা হচ্ছে। বাগান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে আমরা আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ব।”

স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে জানা গেছে, চা বাগানের শ্রমিকদের অধিকাংশই মৌসুমী, যারা চা তোলার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। এখন কাজ বন্ধ থাকায় তারা দিনমজুর হয়ে পড়েছেন।

বাগান মালিকপক্ষ ও শ্রমিকদের মধ্যে সমাধানের প্রচেষ্টা

বাগান মালিকপক্ষ জানিয়েছে, পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য তারা দ্রুত আলোচনা শুরু করবেন। পঞ্চায়েত ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে মিটিং করে চা বাগান পুনরায় চালু করার চেষ্টা করা হবে।

পঞ্চায়েত সভাপতি অনিল ভুমিজ বলেন, “আমরা চাই চা বাগান পুনরায় খোলা হোক। শ্রমিকদের জীবিকা ফিরিয়ে দিতে প্রশাসন এবং মালিকপক্ষের সহযোগিতা প্রয়োজন।”

চা শিল্পে শ্রমিক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার গুরুত্ব

চা শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে মাধবপুর, হবিগঞ্জ ও সিলেট অঞ্চলে চা বাগান শ্রমিকদের জন্য প্রধান জীবিকার উৎস। তাই শ্রমিক নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা এবং ন্যায্য কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চা বাগানে ম্যানেজার ও শ্রমিকদের মধ্যে সমন্বয় না থাকলে ভবিষ্যতেও এমন সংঘর্ষ ঘটতে পারে। শ্রমিকদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং ম্যানেজারদের দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এমন পরিস্থিতি প্রতিরোধ করা সম্ভব।

সম্ভাব্য সমাধান ও সরকারের ভূমিকা

সরকারের শ্রম অধিদপ্তর, স্থানীয় প্রশাসন ও শ্রম আইন অনুযায়ী, চা শ্রমিকদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। শ্রমিকদের বেকারত্ব দূর করতে সরকারি সহায়তা, ক্ষতিপূরণ এবং পুনঃচাকরির ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।

চা শ্রমিক নেতা সমীর কর্মকার বলেন, “আমরা চাই প্রশাসন ও মালিকপক্ষ দ্রুত উদ্যোগ নিক। শ্রমিকদের জীবন নির্বাহ ও পরিবার রক্ষা করতে হবে। এটি কেবল আমাদের নয়, পুরো এলাকার জন্য জরুরি।”

হবিগঞ্জের মাধবপুরে বৈকুন্ডপুর চা বাগানের অনির্দিষ্টকালীন বন্ধ ঘোষণার ঘটনা, শ্রমিকদের জীবিকা ও নিরাপত্তার গুরুত্ব পুনরায় সামনে এনেছে। মালিকপক্ষ, শ্রমিক, পঞ্চায়েত এবং প্রশাসনের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা এবং চা বাগান পুনরায় চালু করা জরুরি।

এছাড়া চা শিল্পে শ্রমিক নিরাপত্তা, নিয়ম-শৃঙ্খলা এবং ন্যায্যভাবে কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করা দেশের অর্থনীতি ও স্থানীয় জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কীভাবে শ্রমিকদের ক্ষতি পূরণ হবে এবং চা বাগান পুনরায় স্বাভাবিকভাবে চালু হবে, তা সময়ই দেখাবে।

MAH – 13487 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button