
মিশরের সিনাই উপত্যকায় অবস্থিত ঐতিহাসিক মুসার পর্বত ঘিরে শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক। সরকার সেখানে বিলাসবহুল রিসোর্ট প্রকল্প হাতে নিয়েছে। অথচ মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের কাছে সমান পবিত্র এই স্থানটি এখন বাণিজ্যিকীকরণের পথে। ফলে স্থানীয় জনগণ, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ এবং আন্তর্জাতিক মহলে ক্ষোভ দানা বেঁধেছে।
পবিত্র মুসার পর্বতে বিলাসবহুল রিসোর্ট নির্মাণ পরিকল্পনা
মিশর সরকার সিনাই উপত্যকার বিখ্যাত মুসার পর্বত বা জাবাল মুসাকে ঘিরে বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে বিলাসবহুল হোটেল, ভিলা, শপিং মল এবং আধুনিক পর্যটন সুবিধা। সরকার দাবি করছে, এই প্রকল্প পর্যটন খাতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে এবং স্থানীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে।
তবে, সমালোচকরা বলছেন—এটি মূলত আধ্যাত্মিক স্থানকে পর্যটন ব্যবসায় পরিণত করার উদ্যোগ, যা ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করছে।
মুসার পর্বতের ধর্মীয় গুরুত্ব
সিনাই উপত্যকার মুসার পর্বত শুধু মুসলিমদের জন্য নয়, বরং খ্রিস্টান ও ইহুদিদের কাছেও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বাস করা হয়, এখানেই হযরত মুসা (আ.) আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেছিলেন এবং ঐশী বাণী লাভ করেছিলেন।
পর্বতের কাছেই অবস্থিত সেন্ট ক্যাথেরিন মঠ, যা ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত এবং বিশ্বের প্রাচীনতম খ্রিস্টান মঠগুলোর একটি। মুসলিম ঐতিহ্য অনুযায়ী, ফাতেমি আমলে মঠের ভেতরে একটি ছোট মসজিদও নির্মিত হয়েছিল, যা ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রতীক হিসেবে এখনো বিদ্যমান।
স্থানীয়দের ক্ষোভ ও বেদুইন সম্প্রদায়ের আপত্তি
এই প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ স্থানীয় বেদুইন জনগোষ্ঠী। দীর্ঘদিন ধরে তারা এই এলাকায় পর্যটন গাইড হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু সরকার তাদের মতামত না নিয়েই প্রকল্প এগিয়ে নিচ্ছে।
ব্রিটিশ লেখক বেন হফলার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “এই উন্নয়ন মূলত বাইরের লোকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। স্থানীয়দের মতামত ও সংস্কৃতি পুরোপুরি উপেক্ষা করা হচ্ছে।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও কূটনৈতিক টানাপোড়েন
গ্রিসসহ বেশ কিছু খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। কারণ, সেন্ট ক্যাথেরিন মঠ গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।
গ্রিক চার্চ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইসলামের নবী মুহাম্মদ (স.) এই মঠের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একটি বিশেষ সনদ দিয়েছিলেন। তাই তারা মনে করছে, মঠের আশেপাশে আধুনিক রিসোর্ট নির্মাণ সেই ঐতিহাসিক চুক্তির লঙ্ঘন।
এছাড়া, ইউনেস্কোও জানিয়েছে, মুসার পর্বত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। সেখানে অতিরিক্ত অবকাঠামো তৈরি হলে ঐতিহাসিক স্থাপনা ঝুঁকির মুখে পড়বে।
অর্থনৈতিক স্বার্থ বনাম ধর্মীয় আবেগ
মিশর সরকার বলছে, সিনাই অঞ্চলে পর্যটন খাত বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। পর্যটন থেকেই দেশটি প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। রিসোর্ট নির্মাণ সম্পন্ন হলে বছরে লাখো পর্যটক আকৃষ্ট হবে বলে আশা করছে তারা।
কিন্তু ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের মতে, অর্থনৈতিক লাভের জন্য আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ বিসর্জন দেওয়া ঠিক নয়। একটি পবিত্র স্থানকে বাণিজ্যিককরণের চেষ্টা দীর্ঘমেয়াদে উল্টো ক্ষতি ডেকে আনবে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষকরা বলছেন, মিশর সরকার যদি স্থানীয় জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ উপেক্ষা করে এগিয়ে যায়, তবে এটি কূটনৈতিক সম্পর্ক ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলতে পারে।
একজন বিশ্লেষকের মতে, “এই প্রকল্পে স্বচ্ছতা এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত না করলে মিশর বড় ধরনের আন্তর্জাতিক বিরোধে জড়িয়ে পড়তে পারে।”
সংক্ষিপ্তসার
মুসার পর্বত শুধু একটি ভৌগোলিক স্থান নয়, এটি মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের মিলনস্থল। সেখানে রিসোর্ট নির্মাণ নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তা নিছক উন্নয়ন নয়—এটি ধর্মীয় অনুভূতি, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও কূটনৈতিক ভারসাম্যের সঙ্গে সম্পর্কিত।
এখন প্রশ্ন হলো, মিশর সরকার কি অর্থনৈতিক লাভের পথ বেছে নেবে, নাকি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে?
এম আর এম – ১২২৪,Signalbd.com