কর্মসংস্থান

ঈদের আগে এখনো হাজারো শ্রমিক বেতন-বোনাস পাননি

পবিত্র ঈদুল আজহার আর মাত্র একদিন বাকি। অথচ দেশের হাজারো পোশাক ও অন্যান্য শিল্পকারখানার শ্রমিক এখনও বেতন-বোনাস পাননি। কারখানাগুলোর অনেকেই এখনো মে মাসের বেতন না দিয়ে বসে আছে, এমনকি এপ্রিল মাসের বেতনও বকেয়া রয়েছে কিছু প্রতিষ্ঠানে। এতে করে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ ও দুশ্চিন্তা বেড়েছে, ঈদে পরিবারের সঙ্গে উৎসব উদযাপন নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।

ত্রিপক্ষীয় সিদ্ধান্ত মানা হয়নি অনেক কারখানায়

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ত্রিপক্ষীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, শ্রমিকদের ঈদ বোনাস ৩১ মে’র মধ্যে এবং মে মাসের বেতন ৩ জুনের মধ্যে পরিশোধ করার কথা ছিল। তবে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এখনো বহু কারখানা এই নির্দেশনা মানেনি। শিল্প পুলিশের তত্ত্বাবধানে থাকা দেশের ৯ হাজার ৬৮৩টি শিল্পকারখানার মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৮৭৪টি এখনো বোনাস দেয়নি, যা মোট কারখানার ১৯ শতাংশ।

সবচেয়ে খারাপ অবস্থা তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতে

শিল্প পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, তত্ত্বাবধানে থাকা ২ হাজার ৪৫৭টি তৈরি পোশাক ও বস্ত্র কারখানার মধ্যে ৪৬৪টি কারখানায় এখনো বোনাস বাকি। এর মধ্যে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-এর সদস্য ২৭৯টি, বিকেএমইএ-এর সদস্য ১৩০টি এবং বিটিএমএ-এর সদস্য ৮১টি কারখানা রয়েছে।

বেতন বাকি মে ও এপ্রিলের

সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, মে মাসের বেতন এখনো ৬০ শতাংশ শিল্পকারখানা দেয়নি। মোট ৫ হাজার ৮৬৪টি কারখানায় মে মাসের বেতন পরিশোধ হয়নি। এর মধ্যে ৩৭৫টি কারখানায় এপ্রিল মাসের বেতনও এখনো বকেয়া রয়েছে।

শুধুমাত্র তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতে মে মাসের বেতন দেয়নি ৭২ শতাংশ কারখানা। বিজিএমইএর ৯৮২টি, বিকেএমইএর ৪৯৮টি এবং বিটিএমএর ৭০টি সদস্য কারখানা এখনো বেতন পরিশোধ করেনি।

বিজিএমইএ’র আলাদা তথ্য ও দাবির ভিন্নতা

অন্যদিকে বিজিএমইএর নিজস্ব প্রতিবেদনে ভিন্ন দাবি করা হয়েছে। তারা বলছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামে তাদের ২ হাজার ৯২টি সচল কারখানার মধ্যে প্রায় ৯৬ শতাংশ ইতোমধ্যে বোনাস দিয়েছে এবং ৫৮ শতাংশ মে মাসের বেতন পরিশোধ করেছে।

এছাড়া এপ্রিল মাসের বেতন এখনো বাকি আছে ১২টি কারখানায়। বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত ৪৮ শতাংশ কারখানা বেতন-বোনাস দিয়ে ছুটি দিয়েছে এবং বাকিরা বৃহস্পতিবারের (৫ জুন) মধ্যে পরিশোধ করবে বলে জানিয়েছেন।

তবে বিজিএমইএর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, এখনো তিনটি কারখানায় বেতন-বোনাস নিয়ে সমস্যা আছে — বসুন্ধরা অ্যাপারেলস, সেজেনস ড্রেসসেইন অ্যাপারেলস

নারায়ণগঞ্জে ১৪ কারখানায় সংকট, ৯টি বিকেএমইএ সদস্য

নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলে ১৪টি শিল্পকারখানায় বেতন-বোনাস নিয়ে জটিলতা রয়েছে। এর মধ্যে ১১টি পোশাক ও বস্ত্র খাতভুক্ত, বাকিগুলো অন্যান্য শিল্পখাতের। উল্লেখযোগ্য কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • হামিদ ফেব্রিকস
  • তোহা নিট ফ্যাশন
  • স্টারলেট কম্পোজিট
  • স্টারলেট অ্যাপারেলস
  • জননী ফ্যাশন
  • ইয়াং থ্রি ফ্যাশন
  • এশিয়ান টেক্সটাইল মিলস
  • ফ্যাশন ওয়ার্ল্ড
  • টোটাল ফ্যাশন
  • অবন্তি কালার টেক্স
  • ক্রোনি অ্যাপারেলস
  • এলসন ফুডস
  • সাম্পান সুজ

শিল্প পুলিশ–৪-এর পরিদর্শক (গোয়েন্দা) সেলিম বাদশা জানিয়েছেন, কারখানাগুলোর বেতন-বোনাস পরিশোধের সময়সীমা আজকের মধ্যে এবং তারা তা নজরদারির আওতায় রেখেছেন।

বিকেএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মনসুর আহমেদ অবশ্য দাবি করেছেন, “বেতন-ভাতা পরিশোধে সমস্যা নেই। অধিকাংশ কারখানা গতকালই (৪ জুন) বেতন দিয়ে ছুটি দিয়েছে। আমরা মালিকদের অন্তত অর্ধেক বেতন দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলাম, যা বেশিরভাগই মেনে চলেছে।”

সাভার-ধামরাইয়েও সমস্যায় ৩২ কারখানা

ঢাকার উপকণ্ঠ সাভার ও ধামরাই উপজেলার ৩২টি তৈরি পোশাক কারখানায় ছাঁটাই, বেতন ও বোনাস নিয়ে সমস্যা চলছে। এসব এলাকার ১ হাজার ৮৬৩টি শিল্পকারখানার মধ্যে ৬০ শতাংশ ৪ জুন ছুটি দিয়েছে।

আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল পুলিশ–১-এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট ৩২টি কারখানায় শ্রমিকদের পাওনা নিশ্চিত করতে তারা কাজ করছেন।

শ্রমিকদের দুঃখ ও অনিশ্চয়তা

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইনবিষয়ক সম্পাদক খাইরুল মামুন বলেন, “অনেক শ্রমিক এখনো বেতন-বোনাস পাননি। ছুটির আগে যদি তারা পাওনা বুঝে না পান, তবে পরিবার নিয়ে ঈদ কীভাবে করবেন? প্রতি ঈদেই একই দৃশ্য খুবই দুঃখজনক।”

সমস্যা সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ জরুরি

ঈদ সামনে রেখে শ্রমিকদের পাওনা বেতন ও বোনাস নিয়ে জটিলতা দেশের বৃহত্তম রপ্তানি খাত পোশাক শিল্পের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। সরকারি নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বেতন-বোনাস পরিশোধ না করায় শ্রমিক অসন্তোষ ও মানবিক বিপর্যয় তৈরি হচ্ছে।

অবিলম্বে সকল শ্রমিকের বকেয়া পরিশোধে মালিক পক্ষ ও সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর আন্তরিকতা ও কার্যকর উদ্যোগ জরুরি।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button