ব্যাংক

সঞ্চয়পত্র বিক্রিসহ ৫ সেবা বন্ধ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক

Advertisement

বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন ঘোষণা করেছে যে, আগামী ৩০ নভেম্বর ২০২৫ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সেবা বন্ধ করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে সঞ্চয়পত্র ও প্রাইজবন্ড বিক্রি, গ্রাহক পর্যায়ে ছেঁড়া-ফাটা নোট বদল, সরকারি চালান সেবা এবং চালান-সংক্রান্ত ভাংতি টাকা প্রদান। প্রথমে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে ব্যাংকের মতিঝিল শাখায়, পরে ধাপে ধাপে অন্যান্য শাখায়ও এই সেবা বন্ধ করা হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই পরিবর্তনের মূল লক্ষ্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কার্যক্রমকে নির্বিঘ্নভাবে চালানো এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি গ্রাহকসেবা প্রদান করে আসলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটি নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ

কেন বন্ধ হচ্ছে এই সেবাগুলো?

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “বিশ্বের অন্য দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাধারণ গ্রাহকের জন্য সরাসরি কাউন্টার সেবা দেয় না। আমাদের দেশের প্রথাও এখন ধীরে ধীরে এই দিকেই এগোচ্ছে।”

মূল কারণগুলো হলো:

  1. নিরাপত্তা ঝুঁকি হ্রাস:
    সঞ্চয়পত্র ও প্রাইজবন্ড সরাসরি বিক্রি করার সময় অত্যধিক নগদ লেনদেন হয়, যা নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
  2. বাণিজ্যিক ব্যাংকের সক্ষমতা বৃদ্ধি:
    সাধারণ গ্রাহকসেবা বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে সরবরাহ করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজের উপর চাপ কমবে এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আরও দক্ষভাবে সেবা দিতে পারবে।
  3. নীতি ও প্রশাসনিক সুবিধা:
    দীর্ঘমেয়াদী নীতিগত কারণে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক গ্রাহকসেবা সরাসরি প্রদানের পরিবর্তে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার নেটওয়ার্ক (ইএফটিএন) ব্যবহারের মাধ্যমে সঞ্চয়পত্রের সুদ ও মূলধনের পরিশোধ করবে।

কোন কোন সেবা বন্ধ হবে?

বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষণায় বলা হয়েছে, এই পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সেবা বন্ধ হবে:

  1. সঞ্চয়পত্র বিক্রি – নতুন সঞ্চয়পত্র বিক্রি বন্ধ।
  2. প্রাইজবন্ড বিক্রি – কোনো নতুন প্রাইজবন্ড আর গ্রাহককে সরাসরি বিক্রি করা হবে না।
  3. ছেঁড়া-ফাটা নোট বদল – গ্রাহক পর্যায়ে নোটের বিনিময় সেবা বন্ধ।
  4. সরকারি চালান সেবা – সরকারি সংস্থার নিকট থেকে নগদ বা চালানের লেনদেনের সেবা বন্ধ।
  5. চালান-সংক্রান্ত ভাংতি টাকা প্রদান – চালানের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বা ভাঙা টাকার সরাসরি প্রদান বন্ধ।

তবে, গ্রাহকদের জন্য ইএফটিএন ব্যবস্থায় সঞ্চয়পত্রের সুদ এবং মূলধনের পরিশোধসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া চালু থাকবে।

সেবা বন্ধের প্রভাব

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সিদ্ধান্তের ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে গ্রাহকসেবা আরও কেন্দ্রভিত্তিক হবে এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি কমবে। তবে, সাধারণ জনগণকে অপ্রত্যাশিতভাবে ভোগান্তির সম্মুখীন হতে দেওয়া যাবে না।

অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি লেনদেনের দায়িত্ব নিতো, সেখানে নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক ঝুঁকি বেশি থাকতো। এখন বাণিজ্যিক ব্যাংক এই দায়িত্ব নিলে সেবা আরও দ্রুত, নিরাপদ ও সহজ হবে।”

আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা

বিশ্বের উন্নত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সাধারণ গ্রাহককে সরাসরি কাউন্টার সেবা দেয় না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়:

  • যুক্তরাজ্য: ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড সরাসরি গ্রাহক লেনদেনের জন্য কোনো কাউন্টার সেবা চালায় না। সমস্ত সঞ্চয়পত্র ও বন্ডের লেনদেন বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে হয়।
  • যুক্তরাষ্ট্র: ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক শুধুমাত্র বাণিজ্যিক ব্যাংকের লেনদেন তদারকি করে, সরাসরি গ্রাহকের সঙ্গে লেনদেন করে না।
  • ভারত: রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া শুধু সুপারভিশারী দায়িত্ব পালন করে, নগদ লেনদেন ও সঞ্চয়পত্র বিক্রির কাজ বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে করা হয়।

এই উদাহরণগুলো বাংলাদেশের নতুন ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

সাধারণ গ্রাহকদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা

বাংলাদেশ ব্যাংক জানাচ্ছে, সঞ্চয়পত্র ও প্রাইজবন্ড সম্পর্কিত লেনদেনের জন্য নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে:

  • ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার নেটওয়ার্ক (ইএফটিএন) – সঞ্চয়পত্রের সুদ এবং মূলধনের পরিশোধ অনলাইন এবং ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে হবে।
  • বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন – গ্রাহকরা তাদের নিকটস্থ ব্যাংক থেকে প্রাইজবন্ড এবং সঞ্চয়পত্র ক্রয় ও লেনদেন করতে পারবেন।
  • নিরাপদ নগদ লেনদেন – ব্যাংকের মাধ্যমে ছেঁড়া-ফাটা নোট বদলের কাজ পরিচালিত হবে, যাতে গ্রাহক সহজে নগদ পরিবর্তন করতে পারেন।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন কর্মকর্তারা মনে করছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি গ্রাহক সেবা প্রদান করলে নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়ে যায়। সেক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দায়িত্ব দেওয়া নিরাপদ এবং কার্যকরী।

অর্থনীতিবিদ ড. হাসানুজ্জামান বলেন, “এই পদক্ষেপ সঠিক সময়ে নেওয়া হয়েছে। এটি ব্যাংকিং খাতের দক্ষতা বাড়াবে এবং গ্রাহকদের সুবিধা আরও সহজ ও নিরাপদ হবে।”

তবে, বিশেষজ্ঞরা আরও সতর্ক করেছেন, যে কোনো পরিবর্তনের সময় সাধারণ মানুষের সুবিধা ও সুবিধাজনক লেনদেন নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই পদক্ষেপ হলো নিরাপত্তা, দক্ষতা ও নীতিগত কারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। ৩০ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই পরিবর্তনের ফলে, গ্রাহকরা সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সেবা না পেলেও, বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং ইলেকট্রনিক চ্যানেলের মাধ্যমে নিরাপদ ও দ্রুত সেবা পেতে পারবেন।

এই পদক্ষেপ দেশের ব্যাংকিং খাতকে আরও আধুনিক, নিরাপদ এবং আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করবে।

MAH – 13842 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button