বাংলাদেশের বেসরকারি ব্যাংকিং খাতে একের পর এক অনিয়মের খবর যখন আলোচনায়, তখন নতুন করে সামনে এসেছে প্রিমিয়ার ব্যাংক ও এইচ বি এম ইকবাল পরিবারকে ঘিরে বড় ধরনের অর্থপাচারের কেলেঙ্কারি।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) তদন্তে প্রমাণ পেয়েছে যে, প্রিমিয়ার ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান এইচ বি এম ইকবাল ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা ব্যাংকের সুবিধা ব্যবহার করে বিদেশে বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন। এই অনিয়মে ব্যাংকের কর্মকর্তারাও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন।
ফলস্বরূপ, বিএফআইইউ ব্যাংকটির বিরুদ্ধে মোট ৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা জরিমানা আরোপ করেছে। একই সঙ্গে ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও পৃথকভাবে আর্থিক জরিমানা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে।
ইকবাল পরিবারের প্রভাবশালী সময় ও ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ
প্রায় দুই দশক ধরে প্রিমিয়ার ব্যাংক ছিল এইচ বি এম ইকবালের নিয়ন্ত্রণে। এক সময়ের প্রভাবশালী এই রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন।
তার আমলে ব্যাংকে নানা অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ একাধিকবার উঠেছিল। অনেকেই বলেছিলেন—প্রিমিয়ার ব্যাংক তখন “ইকবাল পরিবারের ব্যক্তিগত সম্পদ ব্যবস্থাপনার কেন্দ্র” হয়ে উঠেছিল।
তদন্তে দেখা গেছে, ইকবাল ও তার পরিবারের চার সদস্য ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ও রেসিডেন্ট ফরেন কারেন্সি ডিপোজিট (আরএফসিডি) হিসাব ব্যবহার করে বিদেশে বিপুল অর্থ ব্যয় করেছেন। এ সময় তারা বাংলাদেশ ব্যাংক ও বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘন করেন।
বিএফআইইউর তদন্ত: অনিয়মের প্রমাণ একে একে স্পষ্ট
বিএফআইইউর চিঠিতে বলা হয়, ‘অর্থপাচার প্রতিরোধ আইন, ২০১২’ অনুযায়ী ব্যাংকের আরএফসিডি হিসাব খোলার নিয়ম কঠোরভাবে নির্ধারিত। কিন্তু প্রিমিয়ার ব্যাংক সে নিয়ম মানেনি।
ইকবাল পরিবারের নামে খোলা চারটি আরএফসিডি হিসাব ও ১৮টি আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন করা হয়। এসব হিসাবের অনেকগুলোতেই নিয়মবহির্ভূতভাবে অর্থ জমা দেওয়া হয়, আবার অনেকে ঘোষিত ফরম সংরক্ষণ না করেই লেনদেন চালিয়ে যান।
বিএফআইইউ জানায়, ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে এইচ বি এম ইকবাল, তাঁর দুই ছেলে মোহাম্মদ ইমরান ইকবাল ও মইন ইকবাল, মেয়ে নওরীন ইকবাল এবং পুত্রবধূ ইয়াসনা পূজা ইকবালের নামে থাকা কার্ডের মাধ্যমে মোট ৩২ লাখ ৫০ হাজার ৩১১ মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩৯ কোটি টাকার সমপরিমাণ) খরচ হয়েছে।
এই ব্যয়ের পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের নির্ধারিত সীমার চেয়ে অনেক বেশি। ফলে এই লেনদেনগুলোকে অবৈধ অর্থপাচার (Money Laundering) হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
ব্যাংক ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা
বিএফআইইউর তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রিমিয়ার ব্যাংকের বিরুদ্ধে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। পাশাপাশি আরএফসিডি হিসাব ও ক্রেডিট কার্ডে অনিয়মের কারণে ব্যাংককে অতিরিক্ত ২ কোটি ২৪ লাখ টাকা জরিমানা দিতে বলা হয়েছে।
এ ছাড়া, ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তার ব্যক্তিগত দায়ও নির্ধারণ করা হয়েছে—
- সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম রিয়াজুল করিম: জরিমানা ৩০ লাখ টাকা
- বর্তমান অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নওশের আলী: জরিমানা ৩০ লাখ টাকা
- বনানী শাখার তৎকালীন অপারেশন ম্যানেজার মনিরুল করিম লিটন: জরিমানা ২২ লাখ টাকা
- কার্ড বিভাগের দুই প্রধান কর্মকর্তা (২০২০–২০২৪ মেয়াদে দায়িত্বে থাকা): প্রত্যেককে ১০ লাখ টাকা
- ২২ বার ক্রেডিট কার্ড সীমা বাড়ানোর অনিয়মে জাকির হোসেন জিতু: জরিমানা ২২ লাখ টাকা
এই সব জরিমানার অর্থ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগতভাবে পরিশোধ করতে হবে। পাশাপাশি, ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বিধি অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আরও ভয়াবহ অভিযোগ: ‘ইআরকিউ’ হিসাব থেকে টাকা আত্মসাৎ
বিএফআইইউর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ব্যাংকের এক রপ্তানিকারক গ্রাহকের রিটেনশন কোটা (ইআরকিউ) হিসাব থেকে অনুমতি ছাড়াই ১ লাখ মার্কিন ডলার (প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা) স্থানান্তর করা হয় ইকবাল ও তার ছেলে মইন ইকবালের হিসাবে।
এ ঘটনাকে ‘চুরি ও প্রতারণা’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে ব্যাংকের বিরুদ্ধে আলাদাভাবে ১ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
অর্থাৎ শুধু নিয়ম ভঙ্গ নয়, ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ অর্থই সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল বলে তদন্তে প্রমাণ মিলেছে।
ইকবাল পরিবারের বিদেশে সম্পদ কেনার তথ্য
বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ইকবাল পরিবার বিদেশে বিলাসবহুল কেনাকাটা, হোটেল ও রিসোর্টে অবস্থান, বিদেশি গাড়ি ক্রয়সহ একাধিক সম্পত্তি অর্জন করেছেন।
এর মধ্যে কিছু ক্রয়ের তথ্য পাওয়া গেছে লন্ডন, দুবাই ও কুয়ালালামপুরে। তদন্তে দেখা যায়, এসব লেনদেনে ব্যবহৃত অর্থের কোনো বৈধ উৎস ব্যাংকে দেখানো হয়নি।
আইন অনুযায়ী, দেশে অর্জিত অর্থ বিদেশে বিনিয়োগ করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু ইকবাল পরিবার কোনো অনুমোদন ছাড়াই এসব লেনদেন চালিয়ে গেছে।
বিএফআইইউর সতর্কতা ও পরবর্তী পদক্ষেপ
বিএফআইইউর চিঠিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে—যদি আগামী রোববারের মধ্যে ব্যাংক এই জরিমানার অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা না দেয়, তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি প্রিমিয়ার ব্যাংকের হিসাব থেকে অর্থ কেটে নেবে।
এছাড়া, ইকবাল পরিবারের বিরুদ্ধে পৃথকভাবে অর্থপাচার মামলা দায়েরের সুপারিশ করা হয়েছে, যা শিগগিরই দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন)-এর কাছে পাঠানো হতে পারে।
বিএফআইইউ বলেছে, “এই ঘটনায় অর্থপাচারের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। আইন অনুযায়ী, সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার সুযোগ রয়েছে।”
ইকবাল ও তাঁর পরিবারের রাজনৈতিক পটভূমি
এইচ বি এম ইকবাল ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী রাজনীতিক। তিনি একসময় ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
২০০৭ সালের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ইকবালের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা হয়েছিল। সেসময় তিনি দেশের বাইরে অবস্থান নেন।
বর্তমানে ইকবাল ও তাঁর পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য বিদেশে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। বিএফআইইউ মনে করছে, তারা বিদেশে অর্জিত সম্পদ রক্ষা ও নতুন বিনিয়োগের চেষ্টায় আছেন।
ব্যাংক খাতে আস্থা সংকট ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি
অর্থনীতিবিদদের মতে, প্রিমিয়ার ব্যাংকের এই কেলেঙ্কারি শুধু একটি ব্যাংকের নয়, বরং বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের গভীর দুর্বলতার প্রতিফলন।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান হাবিব বলেন,
“বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ও স্বজনপ্রীতি এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এই ধরনের কেলেঙ্কারি ব্যাংক খাতে সাধারণ মানুষের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি জানিয়েছে, তারা সব বেসরকারি ব্যাংকের আরএফসিডি ও ক্রেডিট কার্ড লেনদেন কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। বিশেষ করে চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের পরিবারের লেনদেনের ওপর আলাদা নজর দেওয়া হবে।
সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ প্রশ্ন
এই কেলেঙ্কারি প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে বলছেন, “একটি পরিবারের জন্য পুরো ব্যাংক খাতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।”
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, “যদি এই ধরনের অনিয়মের বিচার দ্রুত না হয়, তাহলে অন্য ব্যাংকের কর্মকর্তারাও একইভাবে আইন ভঙ্গ করতে সাহস পাবে।”
জনগণের প্রশ্ন—এইচ বি এম ইকবাল ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে বাস্তবে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না? নাকি আগের মতো তদন্তের পর বিষয়টি চাপা পড়ে যাবে?
প্রিমিয়ার ব্যাংকের এই অনিয়ম বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের জন্য একটি সতর্কবার্তা। একটি পরিবার ও কিছু কর্মকর্তার ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষায় ব্যাংকের নীতি, আইন ও দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা পর্যন্ত উপেক্ষা করা হয়েছে।
বিএফআইইউর এই পদক্ষেপ শুধু জরিমানা নয়—এটি দেশের ব্যাংক খাতে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। এখন দেখার বিষয়, ইকবাল পরিবার ও ব্যাংকের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ কতটা দৃঢ়ভাবে বাস্তবায়িত হয়।
MAH – 13757 I Signalbd.com



