বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এখন নতুন এক আর্থিক বাস্তবতার মুখোমুখি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে— বাংলাদেশ ব্যাংক আর কোনোভাবেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে জামানত ছাড়া ঋণ বা তারল্য সহায়তা দিতে পারবে না।
এই নির্দেশের অর্থ দাঁড়ায়, যেসব ব্যাংক বর্তমানে আর্থিক দুর্বলতায় ভুগছে, তারা আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে অনিরাপদ বা জামানতহীন সহায়তা পাবে না। এটি বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
আইএমএফের নতুন শর্ত ও পটভূমি
বাংলাদেশ ২০২৩ সালে আইএমএফের সঙ্গে ৫.৫ বিলিয়ন ডলারের একটি ঋণ কর্মসূচি চুক্তি করে। এ কর্মসূচির আওতায় এখন পর্যন্ত পাঁচটি কিস্তি পেয়েছে বাংলাদেশ। ষষ্ঠ কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে আইএমএফ ঢাকায় এসে আর্থিক খাতের সামগ্রিক অগ্রগতি যাচাই করছে।
আইএমএফ প্রতিনিধি দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন পাপাজর্জিও। বুধবার (২৯ অক্টোবর) বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহারের নেতৃত্বে প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও তিন ডেপুটি গভর্নরসহ নীতি-নির্ধারকরা।
বৈঠকে আইএমএফ স্পষ্ট জানিয়ে দেয়— ‘আনসিকিউরড লেন্ডিং’ বা জামানত ছাড়া ঋণ দেওয়া এখনই বন্ধ করতে হবে। কারণ এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং দেশের সামগ্রিক আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।
কেন এই শর্ত আনল আইএমএফ?
গত কয়েক বছরে কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংক লুটপাট, রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে প্রায় দেউলিয়া হওয়ার পথে পৌঁছেছিল। সরকারও বারবার তাদের উদ্ধার করেছে।
এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংক “লেন্ডার অব দ্য লাস্ট রিসোর্ট” হিসেবে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখতে জামানতবিহীন অর্থ সহায়তা দেয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন পর্যন্ত প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা এমন ব্যাংকগুলোকে ঋণ দিয়েছে। কিন্তু এসব ব্যাংক এখনো সেই টাকা ফেরত দিতে পারেনি। এমনকি তাদের অধিকাংশের হাতে পর্যাপ্ত সম্পদ বা বিল-বন্ডও নেই, যা জামানত হিসেবে ব্যবহার করা যেত।
ফলে তারা শুধু একটি প্রতিশ্রুতিপত্র (Demand Promissory Note) জমা দিয়েছিল, যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল— কিন্তু বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীরব প্রতিক্রিয়া
আইএমএফের এই শর্তের পরও বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। বৈঠকে ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহার বলেন, বিষয়টি নীতিগত আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে এবং তা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তা মনে করছেন, এই শর্ত কার্যকর হলে দুর্বল ব্যাংকগুলো টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। ইতিমধ্যে কিছু ব্যাংকের তারল্য সংকট, মূলধন ঘাটতি ও গ্রাহক আস্থার সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে।
দুর্বল ব্যাংকগুলোর পেছনের গল্প
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারিগুলোর কিছু ঘটেছে গত এক দশকে। কিছু রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও পরিচালক ব্যাংকের ভেতর থেকেই কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অনেক ব্যাংক কেবল ‘কাগজে টিকে থাকা প্রতিষ্ঠান’। তাদের বাস্তব সম্পদ ও মূলধন তেমন কিছুই নেই। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানাভাবে তাদের সাহায্য করে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন,
“জামানত ছাড়া ব্যাংককে ঋণ দেওয়া মানে জনগণের রিজার্ভ ঝুঁকিতে ফেলা। এখন সময় এসেছে কঠোর হওয়ার। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে হয় একীভূত করতে হবে, নয়তো বাজার থেকে বিদায় নিতে হবে।”
বৈঠকের অন্যান্য আলোচ্য বিষয়
বুধবারের বৈঠকে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ইস্যু উঠে আসে—
- রিস্ক বেইজড সুপারভিশন (ঝুঁকিনির্ভর তদারকি)
- দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা বন্ধের পরিকল্পনা
- অমানত উত্তোলনে সীমা আরোপের নীতিমালা
- পাঁচটি ব্যাংক একীভূতকরণের অগ্রগতি পর্যালোচনা
- ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিন্যান্স প্রণয়নের খসড়া
সবগুলো আলোচনার মূল লক্ষ্য— ব্যাংক খাতকে টেকসই ও স্বচ্ছ পথে নিয়ে আসা।
ঋণ কিস্তি ও বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত আইএমএফ থেকে পাঁচ কিস্তিতে প্রায় ৩৬৫ কোটি ডলার পেয়েছে।
- প্রথম কিস্তি: ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি — ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার
- দ্বিতীয় কিস্তি: ২০২৩ সালের ডিসেম্বর — ৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলার
- তৃতীয় কিস্তি: ২০২৪ সালের জুন — ১১৫ কোটি ডলার
- চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি: ২০২৫ সালের জুন — ১৩৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার
ষষ্ঠ কিস্তির অর্থ ছাড়ের সময় নির্ধারিত হয়েছে আগামী ডিসেম্বর ২০২৫। তবে জাতীয় নির্বাচন সামনে থাকায় অর্থ ছাড়ে দেরি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আইএমএফ চাইছে, নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে কিনা— সেটি নিশ্চিত হোক।
অর্থনীতিতে সম্ভাব্য প্রভাব
আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী যদি বাংলাদেশ ব্যাংক জামানত ছাড়া আর কোনো ঋণ না দেয়, তাহলে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।
এই ব্যাংকগুলো সাধারণত রাষ্ট্রায়ত্ত বা ছোট বেসরকারি ব্যাংক, যেগুলোর পরিচালনা দুর্বল ও খেলাপি ঋণের হার ৩০ শতাংশেরও বেশি।
এমন পরিস্থিতিতে কিছু ব্যাংককে হয় বড় ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত (merger) করা হতে পারে, নয়তো তাদের কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে।
তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই কড়াকড়ি সিদ্ধান্ত দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এতে ব্যাংক খাতে জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও আর্থিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।
অর্থনীতিবিদদের মতামত
অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন,
“আইএমএফের এই শর্ত কঠিন হলেও প্রয়োজনীয়। বাংলাদেশের ব্যাংক খাত বছরের পর বছর ধরে দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি নরম থাকে, তাহলে জনগণের টাকা আরও ঝুঁকির মুখে পড়বে।”
অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান মন্তব্য করেন,
“এখন সময় এসেছে ব্যাংক খাতে প্রকৃত সংস্কার আনার। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে বাঁচানোর নামে আর জনগণের টাকায় ভর্তুকি দেওয়া যাবে না।”
সরকারের অবস্থান কী?
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সরকার আইএমএফের শর্তগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। তবে নির্বাচনকালীন সময়ে বড় কোনো নীতিগত পরিবর্তন না আনাই হতে পারে সরকারের অবস্থান।
তিনি বলেন,
“আমরা চাই না নির্বাচনের আগে ব্যাংক খাতে হঠাৎ ধাক্কা লাগুক। তবে নির্বাচনের পর নতুন সরকার এ বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নেবে বলে আশা করা হচ্ছে।”
সামনের চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—
১. দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখা,
২. জামানতবিহীন ঋণ বন্ধ রেখে তারল্য সংকট সামাল দেওয়া,
৩. আইএমএফের শর্ত পূরণ করে পরবর্তী কিস্তি নিশ্চিত করা।
এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস, ডলারের দামের অস্থিরতা ও আমদানি ব্যয় বৃদ্ধিও আর্থিক খাতের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে।
কেন ‘জামানতহীন ঋণ’ বিপজ্জনক
জামানতহীন ঋণ মানে হলো, ঋণগ্রহীতা কোনো সম্পদ বা বন্ড জমা না রেখে টাকা নেয়। এতে ঋণ ফেরত না দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষতি হয়, আর সেই ক্ষতি শেষ পর্যন্ত জনগণের ওপরই বর্তায়।
উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো দুর্বল ব্যাংক ৫০০০ কোটি টাকা নেয় এবং তা ফেরত না দেয়, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই সেই ঘাটতি মেটাতে হয়। এতে মুদ্রাস্ফীতি, টাকা ছাপানো ও রিজার্ভ ঘাটতির ঝুঁকি বাড়ে।
তাই আইএমএফের মতে, জামানত ছাড়া ঋণ দেওয়া বন্ধ করা ছাড়া বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংক এখন এক সংবেদনশীল মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে রক্ষা করার চাপ, অন্যদিকে আইএমএফের কঠোর শর্ত।
দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রভাব, খেলাপি ঋণ, দুর্বল পরিচালনা ও অব্যবস্থাপনার দায় এখন পুরো ব্যাংকিং খাতকে নাড়িয়ে দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি এখনই কঠিন সিদ্ধান্ত না নেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যতে এই সংকট আরও গভীর হতে পারে। তাই আইএমএফের শর্ত শুধু বিদেশি চাপ নয়— এটি দেশের আর্থিক ব্যবস্থার আত্মশুদ্ধির সুযোগও হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য এটি এক কঠিন কিন্তু প্রয়োজনীয় সময়। জামানত ছাড়া ঋণ বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে কিছু ব্যাংককে চাপে ফেলবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি দেশের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী ও স্বচ্ছ করবে।
MAH – 13554 I Signalbd.com



