বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাতের একটি নতুন যুগের সূচনা হতে যাচ্ছে। দেশের শরিয়াহভিত্তিক পাঁচটি ব্যাংক একীভূত হয়ে নতুন একটি ব্যাংক গঠন করতে যাচ্ছে, যার নাম চূড়ান্তভাবে রাখা হয়েছে ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’। এটি শুধু ব্যাংকিং খাতেই নয়, দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায়ও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনবে।
কোন কোন ব্যাংক একীভূত হচ্ছে?
একীভূত ব্যাংক গঠনের উদ্যোগে যারা রয়েছেন, তারা হলো:
- ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক
- ইউনিয়ন ব্যাংক
- গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক
- সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক
- এক্সিম ব্যাংক
এই পাঁচ ব্যাংককে একত্রিত করে নতুন ব্যাংকটির অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এটিকে সরকারি খাতের একটি ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সরকার ২০ হাজার কোটি টাকার মূলধন জোগাবে।
সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় এক বছর ধরে এই পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। এ প্রক্রিয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ ৯ অক্টোবর এই প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।
নতুন ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন হবে ৪০ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে পরিশোধিত মূলধন ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা সরাসরি সরকার প্রদান করবে, যেখানে ১০ হাজার কোটি নগদ এবং ১০ হাজার কোটি সুকুক বন্ড এর মাধ্যমে দেওয়া হবে।
শেয়ার রূপান্তর ও ঋণ সংক্রান্ত ব্যবস্থা
নতুন ব্যাংকের মূলধনের ১৫ হাজার কোটি টাকা হবে শেয়ার রূপান্তরের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের অংশ। এ প্রক্রিয়ায় গ্রাহক ও অন্যান্য পাওনাদারের ঋণের কিছু অংশ শেয়ারে রূপান্তর করা হবে। পরবর্তীতে এই শেয়ারগুলি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় নগদে রূপান্তরিত করা হবে।
সরকার গঠিত কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নতুন ব্যাংকের সংঘবিধি ও সংঘস্মারক চূড়ান্তকরণ প্রক্রিয়া চলছে। এটি আইন মন্ত্রণালয়ে পর্যালোচনার জন্য পাঠানো হবে, এবং অনুমোদনের পর আরজেএসসি (জয়েন্ট রেজিস্ট্রার অব কোম্পানিজ ও ফার্মস)-এ নিবন্ধনের প্রক্রিয়া শুরু হবে।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে প্রভাব
একীভূত ব্যাংকের মাধ্যমে দেশীয় ব্যাংকিং খাতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসবে:
- শাখা ও জনবল ব্যবস্থাপনা: একাধিক জেলা শহরে একই ধরনের শাখা থাকার কারণে, কিছু শাখা একত্রিত করা বা অন্য উপজেলায় স্থানান্তর করা হবে।
- আমানত ও ঋণের নতুন হিসাব-নিকাশ: প্রতিটি ব্যাংকের আমানত, ঋণ ও ট্রেজারি ব্যবস্থাপনা পুনঃনিরীক্ষা করা হবে।
- প্রযুক্তি ও নেটওয়ার্ক: আইটি, এটিএম এবং অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা নতুনভাবে সমন্বয় করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, “এই প্রক্রিয়ায় ব্যাংকের গ্রাহকরা কোন অসুবিধায় পড়বেন না। সব ধরনের রূপান্তর এবং একীভূতকরণ ধাপে ধাপে সম্পন্ন করা হবে।”
শাখা নেটওয়ার্ক ও জনবল সংক্রান্ত পরিকল্পনা
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নূরুল আমিন বলেন,
“ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমাদের লিখিত সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা চলছে। তবে সব হিসাব-নিকাশ, শাখা, জনবল এবং এটিএম নেটওয়ার্কের পুনর্বিন্যাস অনানুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকও জনবল ও প্রযুক্তি বিভাগে সমন্বয় নিয়ে কাজ করছে। বিভিন্ন জেলা শহরের একাধিক শাখা একত্রিত করে কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে।
সরকারের মূল উদ্দেশ্য
সরকারের মূল উদ্দেশ্য হলো:
- শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং খাতের শক্তি বৃদ্ধি করা।
- বিনিয়োগ ও ঋণ প্রদানের খাতে কার্যকরী এবং সমন্বিত ব্যাংকিং ব্যবস্থা তৈরি করা।
- আর্থিক খাতে বড় ধরনের দক্ষতা বৃদ্ধি করা এবং আন্তর্জাতিক মানের ব্যাংকিং পরিবেশ তৈরি করা।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই উদ্যোগ দেশের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলবে। একীভূত ব্যাংকটি বড় মূলধনের মাধ্যমে বৃহৎ বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবে।
আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় প্রভাব
বাংলাদেশে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং খাতের বিস্তার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই একীভূত ব্যাংক আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের আইসলামিক ফাইনান্স খাতকে শক্তিশালী করবে। বিশেষ করে সুকুক বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহের প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় হবে।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা
- নতুন ব্যাংকটি ২০২৫ সালের শেষের মধ্যে পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর হবে।
- প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় শাখা পুনর্বিন্যাস এবং সেবা সম্প্রসারণ হবে।
- নতুন ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ, আমানত ও বিনিয়োগে সমন্বয় বৃদ্ধি পাবে।
গ্রাহকদের সুবিধা
একীভূতকরণের ফলে:
- গ্রাহকদের সেবা আরও সমন্বিত ও দক্ষ হবে।
- একাধিক ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত সমস্যা হ্রাস পাবে।
- ডিজিটাল ব্যাংকিং, এটিএম ও অনলাইন লেনদেনে সহজ ও দ্রুত সেবা প্রদান সম্ভব হবে।
‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’ গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং খাতকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে প্রস্তুত। সরকারি সহায়তা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমন্বয় এবং ব্যাংকগুলোর প্রস্তুতি একত্রিত হয়ে দেশের আর্থিক খাতের স্থায়িত্ব ও প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করবে।
এই একীভূতকরণ শুধু ব্যাংকগুলোর জন্য নয়, দেশের বিনিয়োগ, ঋণ, সঞ্চয় এবং আর্থিক সেবা গ্রহণকারীদের জন্যও উপকারী হবে।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে এটি এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হিসেবে ধরা হচ্ছে, যা আগামী দশক ধরে দেশের অর্থনৈতিক দৃঢ়তা ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
MAH – 13501 I Signalbd.com



