
পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলা আবারও উত্তেজনায় কাঁপছে। অষ্টম শ্রেণির এক স্কুলছাত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার পর পাহাড়ি শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের ক্ষোভ রাস্তায় ফুটে ওঠে। টানা অবরোধ, বিক্ষোভ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনায় জেলা জুড়ে এখন থমথমে পরিস্থিতি।
এর মধ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা অভিযোগ তুলেছেন— “এই আন্দোলন ও সহিংসতার পেছনে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন রয়েছে।”
ধর্ষণ থেকে সহিংসতায় বিস্তার
খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার সিঙ্গিনালা এলাকায় ২৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় অষ্টম শ্রেণির এক পাহাড়ি ছাত্রী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। এ ঘটনায় অভিযুক্ত শয়ন শীল (১৯) নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তবে ভুক্তভোগী ও স্থানীয়দের দাবি— এতে একাধিক ব্যক্তি জড়িত, যাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করতে হবে।
এই ঘটনার প্রতিবাদে পাহাড়ি ছাত্র সংগঠন ও স্থানীয় মানুষ জুম্ম ছাত্র-জনতার ব্যানারে আন্দোলনে নামে। প্রথমে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ হলেও ধীরে ধীরে তা সহিংস রূপ নেয়। অবরোধের সময় টায়ারে আগুন, গাছ ফেলে সড়ক অবরোধ, গাড়ি ভাঙচুর, দোকানে হামলার মতো ঘটনা ঘটে।
সহিংস পরিস্থিতি ও ১৪৪ ধারা
শনিবার দুপুর থেকে সদর উপজেলা পরিষদ এলাকা, মহাজনপাড়া, নারিকেল বাগান, চেঙ্গী স্কোয়ারসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ফাঁকা গুলি ও টিয়ারশেল ছুড়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে।
এতে অন্তত ২৫ জন আহত হন। গুরুতর আহত একজনকে চট্টগ্রামে পাঠানো হয়েছে। সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় খাগড়াছড়ি পৌরসভা, সদর উপজেলা ও গুইমারা উপজেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।
বর্তমানে ৭ প্লাটুন বিজিবি, সেনাবাহিনী ও পুলিশ যৌথভাবে রাস্তায় রাস্তায় টহল দিচ্ছে। তবে সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্ক রয়ে গেছে।
পর্যটকদের দুর্ভোগ
ঘটনার দিন সাজেকে বেড়াতে যাওয়া প্রায় দুই হাজার পর্যটক আটকা পড়েন। পরে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় তারা খাগড়াছড়ি শহরে ফিরে আসেন এবং রাতেই নিজ নিজ গন্তব্যে যাত্রা করেন। তবুও শহরের বিভিন্ন হোটেলে এখনো বিপুলসংখ্যক পর্যটক আটকে আছেন।
পর্যটননির্ভর খাগড়াছড়ি জেলার অর্থনীতিতে এই অশান্ত পরিস্থিতির নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
বৌদ্ধ বিহারে নাশকতার চেষ্টায় আটক ৩
শনিবার রাতে খাগড়াছড়ি শহরের একটি বৌদ্ধ বিহারে নাশকতার প্রস্তুতিকালে তিন যুবককে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। প্রশাসনের আশঙ্কা— এই ঘটনায় সাম্প্রদায়িক উসকানি ছড়ানোর চেষ্টা হতে পারে।
উপদেষ্টার অভিযোগ: “তৃতীয় পক্ষ সক্রিয়”
রোববার জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা বলেন—
“খাগড়াছড়িতে ধর্ষণ একটি দুঃখজনক ঘটনা। কিন্তু এই ঘটনার প্রতিবাদে যেভাবে সহিংসতা ছড়ানো হচ্ছে, তার পেছনে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন রয়েছে। এই ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রমের উদ্দেশ্য হলো অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি।”
তিনি আরও বলেন, প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে শান্তি বজায় রাখতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও প্রেক্ষাপট
বিশ্লেষকরা বলছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বহু বছর ধরেই অস্থিতিশীলতার শিকার। ভূমি বিরোধ, জাতিগত দ্বন্দ্ব, পাহাড়ি-বাঙালি উত্তেজনা, সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রভাব— সব মিলিয়ে এখানে রাজনীতি সবসময় জটিল।
একটি অপরাধমূলক ঘটনা থেকে শুরু হয়ে দ্রুত বড় আকার ধারণ করা আন্দোলন ও সহিংসতার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রস্তুতি
খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে আছে। সেনা-বিজিবি-পুলিশ যৌথ টহল অব্যাহত থাকবে। শহরে প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে।
সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া
স্থানীয় মানুষেরা বলছেন— ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের বিচার তারা দ্রুত চান। তবে আন্দোলনের নামে সহিংসতা, ভাঙচুর, পর্যটকদের হয়রানি ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করার বিরুদ্ধে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
অতীতের পুনরাবৃত্তি?
খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে অতীতে একাধিকবার এমন ঘটনার জেরে সহিংসতা ছড়িয়েছে। ২০১৮ সালে রাঙামাটির নানিয়ারচরে সংঘর্ষে কয়েকজন নিহত হন। ২০১৭ সালে রাঙামাটির লংগদুতে অগ্নিসংযোগে শতাধিক ঘর পুড়ে যায়। এসব ঘটনার পেছনেও রাজনৈতিক ও তৃতীয় পক্ষের ইন্ধনের অভিযোগ উঠেছিল।
শান্তি প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ
পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পরও শান্তি পুরোপুরি আসেনি। নানা জটিলতা, আস্থাহীনতা ও গোষ্ঠীগত বিভাজনের কারণে প্রায়ই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। খাগড়াছড়ির সাম্প্রতিক ঘটনা আবারও সেই ভঙ্গুর বাস্তবতাকে সামনে এনেছে।
খাগড়াছড়িতে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীর ওপর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় ক্ষোভ অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সেই ক্ষোভকে পুঁজি করে যদি কোনো শক্তি রাজনৈতিক বা গোষ্ঠীগত স্বার্থে সহিংসতা ছড়ায়— তবে সেটি সমগ্র অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি।
সরকারি পর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপ, অপরাধীদের দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করা এবং সব পক্ষের মধ্যে আস্থা পুনর্গঠন ছাড়া পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।
MAH – 13054 I Signalbd.com