
দেশে বিপুল পরিমাণ জাল নোট প্রবেশের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক নাগরিকদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছে। বুধবার (১৫ অক্টোবর) কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক জনসচেতনতামূলক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে নগদ লেনদেনের সময় জাল নোট শনাক্তে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছে। পাশাপাশি, বড় অঙ্কের লেনদেনে ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহারের পরামর্শও দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তিতে যা বলা হয়েছে
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং গণমাধ্যমে দেশের বাজারে জাল নোট প্রবেশের বিষয়ে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তা জনসাধারণের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এ পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার জন্যই এই সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নগদ লেনদেনের সময় প্রত্যেক নাগরিককে অবশ্যই নোটের আসল ও জাল পার্থক্য যাচাই করতে হবে। নোটের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে—ওয়াটারমার্ক, নিরাপত্তা সুতা, উঁচু প্রিন্টিং বা ইন্টাগ্লিও ছাপা, রঙ পরিবর্তনশীল কালি, এবং ক্ষুদ্র লেখা বা মাইক্রো টেক্সট।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও জানিয়েছে, বড় অঙ্কের লেনদেন হলে তা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে সম্পন্ন করা নিরাপদ। একইসঙ্গে সম্ভব হলে ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে, যাতে জাল নোটের ঝুঁকি কমে আসে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সতর্কবার্তায় বলা হয়, “সত্যিকারের নোট চিনুন, নিরাপদ লেনদেন নিশ্চিত করুন।” সন্দেহজনক কোনো নোট পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
জাল নোট নিয়ে জনমনে উদ্বেগ
সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ কিছু পোস্ট ভাইরাল হয়, যেখানে দাবি করা হয় দেশে বড় পরিমাণে জাল টাকা প্রবেশ করছে। এসব পোস্টে বলা হয়, সীমান্তবর্তী অঞ্চল ও রাজধানীর কিছু বাজারে নতুন ৫০০ ও ১০০০ টাকার জাল নোট ছড়িয়ে পড়েছে।
যদিও এসব তথ্যের সত্যতা স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি, তবুও বিষয়টি নিয়ে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ ব্যাংক এবং বাজারে লেনদেনের সময় নোট যাচাইয়ে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন শুরু করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই বিজ্ঞপ্তি অনেকের কাছে সময়োপযোগী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা জনগণকে সচেতন করবে এবং বাজারে জাল নোটের ঝুঁকি হ্রাসে ভূমিকা রাখবে।
আইন অনুযায়ী জাল নোট রাখা ও ব্যবহার অপরাধ
বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে জাল নোট তৈরি, সংরক্ষণ বা ব্যবহার করা দণ্ডনীয় অপরাধ। দণ্ডবিধির ৪৮৯বি ও ৪৮৯সি ধারায় জাল নোটের সঙ্গে সম্পৃক্ততার জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো ব্যক্তি যদি জানে যে কোনো নোট জাল, তবুও সেটি লেনদেনে ব্যবহার করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হতে পারে। এই অপরাধে দীর্ঘ মেয়াদি কারাদণ্ড এবং জরিমানার বিধান রয়েছে।
এ কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংক জনগণকে যে কোনো সন্দেহজনক নোট সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করার পরামর্শ দিয়েছে। প্রয়োজনে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে যোগাযোগ করার আহ্বানও জানানো হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ ও পদক্ষেপ
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, আসল নোটের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে দেশজুড়ে সব ব্যাংক শাখায় ব্যানার, পোস্টার এবং নির্দেশিকা প্রদর্শন করা হচ্ছে।
এ ছাড়া, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তাদের জন্যও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করা হয়েছে, যাতে তারা দ্রুত আসল ও জাল নোটের পার্থক্য করতে পারেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, “জাল নোট শনাক্তে জনগণকে আরও সচেতন করার জন্য বিশেষ প্রচার কার্যক্রম চলছে। নগদ অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবাইকে নিজ দায়িত্বে নোট যাচাইয়ের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।”
জাল নোটের বিস্তার রোধে প্রযুক্তির ভূমিকা
অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, জাল নোটের বিস্তার রোধে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে ব্যাংকগুলো নোট যাচাই যন্ত্র ব্যবহার করছে, তবে ছোট দোকান বা খুচরা ব্যবসায়ীরা অনেক সময় এমন সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
অর্থনীতিবিদরা পরামর্শ দিয়েছেন, সাধারণ জনগণকেও যেন সহজলভ্যভাবে নোট যাচাই ডিভাইস ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে নোটের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করার প্রযুক্তি চালু করা যেতে পারে, যা উন্নত দেশগুলোতে ইতিমধ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে।
অর্থনীতিতে জাল নোটের প্রভাব
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, বাজারে জাল নোটের প্রচলন অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এটি জনগণের আস্থা নষ্ট করে, মুদ্রানীতির কার্যকারিতা ব্যাহত করে এবং পণ্যের দামের উপরও প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নরদের মতে, “জাল নোট শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি করে না, এটি দেশের ভাবমূর্তিতেও আঘাত হানে। তাই এই বিষয়ে সচেতনতা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা জরুরি।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সতর্কবার্তা নাগরিকদের সচেতন করার পাশাপাশি আর্থিক লেনদেনে স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা বাড়াতে সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে। জাল নোটের প্রবেশ ঠেকাতে জনসচেতনতা, প্রযুক্তি ব্যবহার এবং আইনি পদক্ষেপ একত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, জনগণ যদি নিজ নিজ দায়িত্বে নোট যাচাইয়ের অভ্যাস তৈরি করে এবং ডিজিটাল লেনদেনকে অগ্রাধিকার দেয়, তাহলে জাল নোটের বিস্তার রোধ করা সম্ভব হবে।
এম আর এম – ১৭৯০,Signalbd.com