বানিজ্য

ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শিগগিরই বাণিজ্যচুক্তি: ডোনাল্ড ট্রাম্প

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে বহুদিন ধরেই বাণিজ্যিক সম্পর্ক ঘিরে টানাপোড়েন চলছিল। তবে সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দিয়েছেন—খুব শিগগিরই ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র একটি বাণিজ্যচুক্তিতে পৌঁছাতে যাচ্ছে। একই সময়ে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনারও ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি, যা দুই পারমাণবিক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবেশীর উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

ভারত ও পাকিস্তানের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাণিজ্য

গত শুক্রবার মার্কিন বিমানঘাঁটি জয়েন্ট বেস অ্যান্ড্রুজে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, ‘পাকিস্তানের প্রতিনিধি আসছেন আগামী সপ্তাহে। ভারতের সঙ্গেও আমাদের চুক্তি এই হলো বলে।’ তিনি আরও বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সংঘাত যদি আবারও প্রকট আকার ধারণ করে, তাহলে এই বাণিজ্য আলোচনা বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়বে।

ট্রাম্প বলেন, ‘যদি তারা যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তাহলে আমরা কারও সঙ্গেই চুক্তি করব না। কারণ বাণিজ্য হয় তখনই, যখন পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকে।’ তাঁর এই বক্তব্য স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয়, দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক উত্তেজনা কেবল আঞ্চলিক নিরাপত্তাকেই নয়, বরং বৈশ্বিক বাণিজ্য নীতিকেও প্রভাবিত করছে।

কাশ্মীরের ঘটনার জেরে উত্তপ্ত পরিস্থিতি

২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগামে এক সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হন। এরপর ভারত পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায়। এতে দু’দেশের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা দ্রুত বাড়তে থাকে। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়। ট্রাম্প প্রশাসনের তরফ থেকে জানানো হয়, যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে দুই দেশকে সংঘর্ষ থেকে বিরত রাখতে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

বাণিজ্য আলোচনার অগ্রগতি: তিন ধাপে চুক্তির পরিকল্পনা

বাণিজ্য আলোচনায় উভয় পক্ষই ধাপে ধাপে অগ্রসর হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তিনটি ধাপে এই চুক্তি সম্পন্ন করার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রথম ধাপে জুলাই মাসে একটি অন্তর্বর্তী চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে, ঠিক সেই সময় যখন ট্রাম্প ঘোষিত পাল্টা শুল্ক কার্যকর হবে।

ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রী পীযূষ গোয়েল সম্প্রতি এ বিষয়ে আলোচনা করতে ওয়াশিংটন সফর করেন। আলোচনায় মূলত শুল্ক কাঠামো, সরকারি ক্রয়ে অংশগ্রহণের সুযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সহযোগিতা—এই তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নীতি ও পাকিস্তানের উদ্বৃত্ত বাণিজ্য

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বাণিজ্যঘাটতি হ্রাস এবং ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির আওতায় শুল্ক আরোপের পথে হাঁটেন। পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক বাণিজ্য উদ্বৃত্ত প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার, যা ট্রাম্প প্রশাসনের চোখে ‘অসমানুপাতিক’।

এই কারণে পাকিস্তানি পণ্যে ২৯ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এর ফলে পাকিস্তানের টেক্সটাইল, ক্রীড়া সামগ্রী এবং চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি চাপে পড়েছে। তাই আগামী সপ্তাহে পাকিস্তানের প্রতিনিধিদলের ওয়াশিংটন সফর এই সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

ভারতীয় পণ্যে পাল্টা শুল্ক এবং মার্কিন কোম্পানির সুযোগ

মার্কিন পণ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক আরোপের জবাবে ভারতও পাল্টা ব্যবস্থা নেয়। ২ এপ্রিল ভারতীয় পণ্যে যুক্তরাষ্ট্র ২৬ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করে। তবে উত্তেজনার মধ্যেও আলোচনার দ্বার খোলা রাখা হয়।

রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত তার সরকারি ক্রয়বাজার মার্কিন কোম্পানিগুলোর জন্য আংশিকভাবে উন্মুক্ত করতে রাজি হয়েছে। এই উদ্যোগ কার্যকর হলে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের প্রকল্পে অংশগ্রহণ করতে পারবে। এটি ওয়াশিংটনের জন্য বড় একটি কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক জয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

ট্রাম্পের ‘বাণিজ্য দিয়ে যুদ্ধ থামানোর’ কৌশল

ট্রাম্প একাধিকবার দাবি করেছেন, বাণিজ্য আলোচনার মাধ্যমে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সম্ভাব্য পারমাণবিক সংঘর্ষ এড়ানো গেছে। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা যখন বাণিজ্য নিয়ে কথা বলি, তখন বলি—যারা একে অপরকে গুলি করছে, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে, তাদের সঙ্গে তো আর বাণিজ্য করা যায় না…তারা এটা বুঝেছে এবং রাজি হয়েছে—তাই সব থেমে গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার মতে, সবচেয়ে গর্বের যে চুক্তি তা হলো—আমরা ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে একযোগে কাজ করেছি এবং বাণিজ্যের মাধ্যমে সম্ভাব্য পারমাণবিক যুদ্ধ ঠেকাতে পেরেছি, গুলির বদলে। সাধারণত এটা হয় গুলি দিয়ে, আমরা করেছি বাণিজ্য দিয়ে।’

বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের এই বাণিজ্য উদ্যোগ কেবল অর্থনৈতিক লেনদেন নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ায় কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষার একটি মাধ্যম হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে। ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে একই সময়ে আলাদা আলাদা চুক্তি করায় মার্কিন প্রশাসন তাদের দুইমুখী কূটনৈতিক কৌশলের পরিচয় দিয়েছে।

বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারত ও পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তানের মধ্যে যে উত্তেজনা দীর্ঘদিন ধরে বিরাজ করছে, তা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ঝুঁকির বড় উৎস হিসেবে বিবেচিত। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় অংশগ্রহণ কেবল বাণিজ্য নয়, ভূরাজনীতির দিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ।

উপসংহার

ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শিগগিরই সম্ভাব্য বাণিজ্যচুক্তির ইঙ্গিত দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি বড় অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। একদিকে এই চুক্তি দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও গভীর করবে, অন্যদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সংলাপ দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার প্রয়াসে সহায়ক হবে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে বাণিজ্যকে কূটনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের কৌশল নতুন নয়। তবে এবার তা পারমাণবিক উত্তেজনা প্রশমনে কার্যকর ভূমিকা রাখছে, যা আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button