বানিজ্য

রাখাইনে চীনা বিনিয়োগ হুমকির মুখে বন্দরের দখলের পথে আরাকান আর্মি

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)-এর আওতায় নির্মিত গুরুত্বপূর্ণ বন্দর শহর কিয়াকফিউ বর্তমানে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (AA) সরাসরি হামলার মুখে। শহরটির গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি এবং পুলিশ স্টেশন ইতোমধ্যে দখল করে নিয়েছে এএ, এবং তারা দ্রুতই চীনের বিনিয়োগ-সংলগ্ন অঞ্চলগুলোতে অগ্রসর হচ্ছে।

সেনা কমান্ডার নিহত, শহরের নিয়ন্ত্রণে অগ্রসর বিদ্রোহীরা

থাইল্যান্ডভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ইরাবতি ও স্থানীয় সূত্রের বরাতে জানা গেছে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তার শীর্ষস্থানীয় কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কিয়াও মো অং কিয়াকফিউর কাছে সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন। সংঘর্ষ চলাকালে শহরের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে তা দখল করেছে আরাকান আর্মি।

বিশ্লেষকদের মতে, এটি সামরিক জান্তার জন্য কৌশলগতভাবে এক বড় ধাক্কা। কারণ কিয়াকফিউ হলো মিয়ানমারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর, যা চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোরের (CMEC) একটি প্রধান অংশ। এই বন্দরের মাধ্যমেই চীন বঙ্গোপসাগর থেকে তেল ও গ্যাস আমদানি করে।

চীনের বিনিয়োগ ও তেল শোধনাগার ঝুঁকির মুখে

বিদ্রোহী আরাকান আর্মি এখন কিয়াকফিউ শহর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দক্ষিণে পিয়াং সি কে এলাকায় অবস্থান নিয়েছে, যেখানে সেনাবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তর রয়েছে। এছাড়াও কিয়াকফিউ-রাম্রি জাতীয় সড়কের পাশে পিয়াইন সি কাই জনপদ তারা দখল করে নিয়েছে।

এই এলাকার কাছেই রয়েছে চীনের নির্মিত তেল শোধনাগার, যা এখনও বিদ্রোহীদের দখলের বাইরে থাকলেও ক্রমেই ঝুঁকির মুখে পড়ছে। চীনের বিনিয়োগ রক্ষা ও নিজস্ব স্বার্থে সেখানে চীনা বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থা মোতায়েন রয়েছে, যারা আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে ড্রোন সহায়তা দিয়ে মিয়ানমার জান্তাকে সাহায্য করছে বলে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে।

দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলেও জান্তা বাহিনীর পতন, ১২টি ঘাঁটি নিয়ন্ত্রণে

শুধু রাখাইন নয়, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কারেন ও মন রাজ্য জুড়েও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর অগ্রগতি অব্যাহত। কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (KNU) ও তাদের মিত্র পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (PDF) সম্মিলিতভাবে অন্তত ১২টি সামরিক ঘাঁটি দখলের দাবি করেছে।

বিশেষ করে কারেন রাজ্যের বায়িন্ত নাউং পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি সামরিক ফাঁড়ি শুক্রবার কেএনইউ বাহিনী নিয়ন্ত্রণে নেয়। এতে দক্ষিণ-পূর্ব মিয়ানমারের নিরাপত্তা পরিস্থিতিও চরম অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে।

আরাকান আর্মির অগ্রযাত্রা ও কৌশলগত প্রভাব

আরাকান আর্মির এই দখল অভিযানের পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতিত রাখাইন জনগোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসনের দাবি। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকেই জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে এই গোষ্ঠী।

বিশ্লেষকদের মতে, কিয়াকফিউ শহর ও আশপাশের এলাকায় আরাকান আর্মির এই দখল কেবল সামরিক নয়, বরং চীনের কৌশলগত বিনিয়োগ এবং আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতেও গভীর প্রভাব ফেলবে। চীন মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সাধারণত নিরবতা পালন করলেও তার বিনিয়োগ রক্ষায় সরাসরি জড়িত হওয়ার ইঙ্গিত মিলছে।

চীন কী অবস্থান নেবে?

রাখাইন রাজ্যে চীনের বিনিয়োগ কেবল বন্দর, তেল শোধনাগার বা গ্যাস পাইপলাইনেই সীমাবদ্ধ নয়। এর আওতায় রয়েছে রেললাইন, শিল্পাঞ্চল ও বড় আকারের অবকাঠামো প্রকল্প। এসব বিনিয়োগকে চীন তার সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও কৌশলগত বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে

ফলে, যদি আরাকান আর্মি কিয়াকফিউ দখলে নিতে সক্ষম হয়, তবে চীন হয়ত সরাসরি অথবা বেসরকারি সামরিক কোম্পানির মাধ্যমে প্রতিরোধ জোরদার করতে পারে। তবে এতে মিয়ানমারের সংঘাত আন্তর্জাতিক স্তরে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা বাড়বে।

ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি কোনদিকে যাচ্ছে?

মিয়ানমারে ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশজুড়ে সেনা-বিরোধী সংঘাত তীব্র হয়েছে। আরাকান আর্মি, কেএনইউ, পিডিএফসহ বিভিন্ন সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক এই সাফল্যগুলো বিদ্রোহীদের কৌশলগত অগ্রগতির স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে। বিশেষ করে কিয়াকফিউর মতো কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় এগিয়ে আসা শুধু মিয়ানমার নয়, চীন এবং গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনীতির হিসাবও পাল্টে দিতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button