বানিজ্য

যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবসহ পাঁচ দেশে ১৩ টন আম রপ্তানি

বাংলাদেশি আমের সুবাস ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। চলতি আম মৌসুমে নতুন করে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, জার্মানি, কাতার ও বাহরাইনে রপ্তানি করা হয়েছে ১৩ টন আম। এই রপ্তানি কার্যক্রম উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রীর কৃষিবিষয়ক উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

রাজধানীর বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (BARC) মিলনায়তনে আয়োজিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে এই আম রপ্তানির আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। এতে সরকারি কর্মকর্তা, রপ্তানিকারক, কৃষক প্রতিনিধি ও গবেষকরা অংশ নেন।

বিদেশে বাড়ছে বাংলাদেশি আমের কদর

অনুষ্ঠানে কৃষি উপদেষ্টা বলেন, “বাংলাদেশি আমের বিদেশে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে উৎপাদন ও রপ্তানির পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে। আমরা যদি সঠিকভাবে পরিকল্পনা করি, তাহলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই আম হতে পারে বাংলাদেশের অন্যতম রপ্তানি কৃষিপণ্য।”

তিনি জানান, গোপালভোগ ও হিমসাগর জাতের আম এ বছর বিদেশে ভালো সাড়া ফেলেছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে এই আমের স্বাদ ও মান অনন্য বলে ক্রেতারা মত দিয়েছেন।

প্রণোদনা ও গবেষণার মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা

আমচাষিদের প্রণোদনা বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, “চাষিদের কথা বলার সুযোগ কম, তাই আমরা চাই তাদের হয়ে কথা বলুক নীতি নির্ধারকেরা। কৃষক যাতে তার উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য পায়, সেই বিষয়ে সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে।”

তিনি আরও জানান, হর্টিকালচার সেন্টারগুলোতে উন্নত জাতের আমের চারা উৎপাদন বাড়ানো হবে। স্বল্পমূল্যে এই চারা সরবরাহ করা হবে কৃষকদের কাছে, যাতে তারা রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনে আগ্রহী হয়।

গবেষণা ও প্রযুক্তির ব্যবহার

দেশে কৃষিজমির পরিমাণ কমলেও প্রযুক্তি ও গবেষণার সাহায্যে উৎপাদন কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব হয়েছে বলে জানান কৃষিবিষয়ক উপদেষ্টা। তিনি বলেন, “আমচাষে ফলন বাড়াতে নতুন জাত ও প্রযুক্তির উন্নয়নে আরও গুরুত্ব দিতে হবে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে।”

সমস্যা ও সম্ভাবনার বাস্তবচিত্র

অনুষ্ঠানে আমচাষি ও রপ্তানিকারকেরা ব্যাগিং, প্যাকিং, পরিবহন ও আম সংগ্রহকালীন সমস্যার কথা তুলে ধরেন। তারা জানান, আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে গেলে প্যাকেজিং ও লজিস্টিক সাপোর্ট দরকার হয়, যেটি বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত নয়।

জবাবে উপদেষ্টা আশ্বাস দিয়ে বলেন, “প্রণোদনা, প্রশিক্ষণ এবং সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নত করার মাধ্যমে এই সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান করা হবে।”

উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কৃষিসচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়া। আরও উপস্থিত ছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. মো. মাহমুদুর রহমান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ছাইফুল আলম এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. নাজমুন নাহার করিম।

মৌসুমজুড়ে আম রপ্তানির অগ্রগতি

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুর রহমান জানান, “এখন পর্যন্ত চলতি মৌসুমে ২১টি দেশে ১৬৫ টন আম রপ্তানি করা হয়েছে। আজ (২৮ মে) যুক্ত হয়েছে আরও পাঁচ দেশ—যেখানে একযোগে ১৩ টন আম পাঠানো হয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “আমাদের লক্ষ্য শুধু পরিমাণ বাড়ানো নয়, মানও বজায় রাখা। এজন্য প্রতিটি আম বাগানে ব্যাগিং, প্রাকৃতিক কীটনাশক ব্যবহার ও পর্যবেক্ষণের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।”

রপ্তানিযোগ্য আমের চাষে জোর

বাংলাদেশ থেকে আম রপ্তানি করতে হলে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক দেশের আমদানি নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো রাসায়নিক বালাইনাশকের ব্যবহার ছাড়াই উৎপাদিত আমই গ্রহণযোগ্য।

এই কারণে দেশের বিভিন্ন জেলায় গড়ে উঠেছে “গ্লোবাল গ্যাপ” অনুসরণ করে উৎপাদিত আম বাগান। এসব বাগানে চাষিরা বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করছেন এবং সেখানকার উৎপাদনেই মূলত রপ্তানিযোগ্য আম সংগ্রহ করা হয়।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১২ লাখ টনের বেশি আম উৎপাদিত হয়। তবে এর মধ্যে রপ্তানিযোগ্য অংশ খুবই কম—মোট উৎপাদনের ১ শতাংশেরও নিচে। কৃষি মন্ত্রণালয় ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (EPB) এর লক্ষ্য, আগামী পাঁচ বছরে আম রপ্তানির পরিমাণ ৫ হাজার টন ছাড়িয়ে নেওয়া।

যদি পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হয়, তাহলে আম হতে পারে বাংলাদেশের পরবর্তী বড় কৃষি রপ্তানি পণ্য, যার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি বড় সুযোগ তৈরি হবে।

বাংলাদেশি আম আন্তর্জাতিক বাজারে ধীরে ধীরে একটি ব্র্যান্ডে পরিণত হচ্ছে। এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ, যেখানে সরকার, চাষি, গবেষক ও রপ্তানিকারকেরা একযোগে কাজ করবেন। সরকার যদি প্রণোদনা ও প্রযুক্তি সহযোগিতা অব্যাহত রাখে, তাহলে “বাংলাদেশি আম” হবে ভবিষ্যতে বৈশ্বিক ফল বাজারের অন্যতম আকর্ষণ।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button