অনির্দিষ্টকালের জন্য সারাদেশে জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা

দেশের জুয়েলারি খাতে এক অভূতপূর্ব অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে সহ-সভাপতি মো. রিপনুল হাসানকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতারের পর। বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) বুধবার (২৮ মে) এক বিবৃতিতে ঘোষণা করেছে, এই গ্রেফতারের প্রতিবাদে এবং তার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে সারাদেশের সব জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।
বাজুসের এই ঘোষণার ফলে ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় অবস্থিত হাজার হাজার স্বর্ণ ও রূপার দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও এই ঘোষণায় চরম বিপাকে পড়েছেন। বিশেষ করে বিয়ের মৌসুম ও ঈদের কেনাকাটার ভরা সময়ে এমন সিদ্ধান্তে সবার মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
গ্রেফতারের ঘটনা: কী ঘটেছিল পুরান ঢাকায়?
বুধবার (২৮ মে) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার এলাকায় নিজ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে বাজুসের সহ-সভাপতি মো. রিপনুল হাসানকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি দল। এসময় কোনও ধরনের পূর্ব-নোটিশ বা আদালতের পরোয়ানা ছাড়াই তাকে আটক করা হয় বলে দাবি করেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা ও তার সহযোগীরা।
বাজুসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই গ্রেফতার একটি হয়রানিমূলক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পদক্ষেপ। সংগঠনের নেতারা দাবি করছেন, এটি একজন নিরপরাধ ব্যবসায়ী নেতাকে হেনস্তার একটি অংশ, যার পেছনে কোনো অদৃশ্য উদ্দেশ্য কাজ করছে।
জুসের প্রতিক্রিয়া ও অবস্থান
বাজুসের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি গুলজার আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক বাদল চন্দ্র রায় এক যৌথ বিবৃতিতে মো. রিপনুল হাসানকে গ্রেফতারের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন, “বিনাদোষে একজন সম্মানিত ব্যবসায়ী নেতাকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একটি দৃষ্টান্তহীন উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। এটি দেশের জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞা ও অপমান।”
তারা আরও বলেন, “যতক্ষণ না পর্যন্ত মো. রিপনুল হাসানকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হবে এবং তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা অভিযোগ প্রত্যাহার করা হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সারাদেশে সব ধরনের জুয়েলারি ব্যবসা বন্ধ থাকবে।”
ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ ও উদ্বেগ
দেশের জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা এই ঘোষণার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন এবং দোকান বন্ধ রেখেছেন। অনেক ব্যবসায়ী জানান, তারা ইতোমধ্যেই বিভিন্ন ধরনের লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছেন। অনেকে বড় অর্ডার বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন। এক ব্যবসায়ী বলেন, “আমাদের উপার্জনের মৌসুম এটা। বিয়ে, উৎসব—সবকিছুর জন্য মানুষ স্বর্ণ কেনে। এখন সব বন্ধ, আমরা জানি না কীভাবে সামাল দেব।”
ভোক্তাদের ভোগান্তি
জুয়েলারি দোকান বন্ধ থাকার কারণে সাধারণ ভোক্তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। যারা বিয়ে বা অন্য সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য আগাম অর্ডার দিয়েছিলেন, তারা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন। রাজধানীর এক বাসিন্দা বলেন, “বিয়ের জন্য গহনা তোলার কথা ছিল কালকে। দোকানে গেলে দেখি বন্ধ। ফোনও বন্ধ। এখন বুঝতে পারছি না কী করবো।”
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্য
এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি পাওয়া যায়নি। তবে একটি ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, মো. রিপনুল হাসানের বিরুদ্ধে একটি আর্থিক অনিয়ম সংক্রান্ত মামলায় তদন্ত চলছিল এবং তার অংশ হিসেবেই তাকে আটক করা হয়েছে।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে কাজ করছে। যদি কেউ ক্ষুব্ধ হন বা মনে করেন, আইন লঙ্ঘন হয়েছে, তাহলে তারা আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন।”
অর্থনীতিতে সম্ভাব্য প্রভাব
বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘ সময় ধরে জুয়েলারি দোকান বন্ধ থাকলে অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ, স্বর্ণ ব্যবসা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ খাতে লাখ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। দোকান বন্ধ থাকলে কর্মচারীদের উপার্জন বন্ধ হবে, ভোক্তারা বিকল্প পথে যেতে বাধ্য হবেন এবং সরকারের রাজস্বও হ্রাস পাবে।
অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ রাশেদ বলেন, “এ ধরনের ধর্মঘট বা অচলাবস্থা কেবল ব্যবসার জন্য নয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ভারসাম্যেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পরিস্থিতি দ্রুত সমাধান হওয়া দরকার।”
আন্দোলনের ভবিষ্যৎ ও সরকারী অবস্থান
বাজুসের নেতারা জানিয়েছেন, আন্দোলন শান্তিপূর্ণ থাকবে, তবে তারা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত পিছু হটবেন না। সংগঠনের তরফে ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি স্মারকলিপি পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে।
এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো এই বিষয়ে কোনো উচ্চপর্যায়ের বিবৃতি আসেনি। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা অনানুষ্ঠানিকভাবে জানান, “পরিস্থিতি সরকার পর্যবেক্ষণ করছে এবং প্রয়োজনে সমঝোতার চেষ্টা করা হবে।”
উপসংহার
মো. রিপনুল হাসানের গ্রেফতার এবং তার প্রেক্ষিতে সারাদেশে জুয়েলারি দোকান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনীতি, ব্যবসা এবং সাধারণ মানুষের জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলছে। এই সঙ্কট দ্রুত সমাধানে সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। অন্যথায় একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত আরও দীর্ঘস্থায়ী অচলাবস্থার মুখে পড়তে পারে।