প্রথমবারের মতো আজ চীনে আম রপ্তানি হচ্ছে, যাবে সাতক্ষীরা ও যশোরের আম

বাংলাদেশের কৃষিপণ্য রপ্তানিতে আজ যুক্ত হলো এক নতুন ইতিহাস। প্রথমবারের মতো চীনে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের আম। আজ বুধবার, ২৮ মে ২০২৫ তারিখে দুপুরে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রথম চালানে পাঠানো হচ্ছে ১০ টন আম। এই চালানে রয়েছে সাতক্ষীরা ও যশোর অঞ্চলের উৎকৃষ্ট মানের আম। এটি দেশের আম রপ্তানির ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক।
বহু প্রতীক্ষার পর চীনের বাজারে বাংলাদেশের আম
চীনে আম রপ্তানির এই প্রচেষ্টা হঠাৎ করেই বাস্তবায়িত হয়নি। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা চলছিল কয়েক মাস ধরেই। শেষ পর্যন্ত কিছুদিন আগে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় দুই দেশের মধ্যে। এই মৌসুমে চীনে মোট ১০০ টন আম রপ্তানির পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)-র ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, “প্রথম দফায় আজ ১০ টন আম চীনে রপ্তানি হচ্ছে। ধাপে ধাপে আরও চালান পাঠানো হবে।”
বিশেষ আয়োজন ও আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন
চীনগামী আমের এই প্রথম চালান উপলক্ষে আজ সকালে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এছাড়া, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (BARC)-এ আজ সকালেই এ বছরের আম রপ্তানির কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন কৃষি ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে রাষ্ট্রদূতের সফর এবং ত্বরান্বিত রপ্তানি প্রক্রিয়া
এই রপ্তানির পেছনে কূটনৈতিক ও প্রশাসনিক তৎপরতাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। গত ২৮ এপ্রিল, চীনের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশ সফরকালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম বাগান পরিদর্শন করেন। এরপরই দ্রুত গতি পায় রপ্তানির অনুমোদন ও কার্যক্রম। জানা যায়, মাঠ পর্যায়ের পরিবীক্ষণ, কৃষি স্বাস্থ্য ও প্যাকেজিং বিষয়ে চীন কঠোর মান নির্ধারণ করে রেখেছে, যেগুলো সফলভাবে পূরণ করেছে বাংলাদেশ।
ছয় বছর পর বাস্তবে রপ্তানির সুফল
উল্লেখযোগ্য যে, ২০১৯ সালেই বাংলাদেশ চীনে আমসহ কিছু কৃষিপণ্য রপ্তানির অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছিল। তবে কোভিড-১৯ মহামারিসহ নানাবিধ প্রশাসনিক ও আন্তর্জাতিক জটিলতায় প্রায় ছয় বছর পর আজ এই প্রচেষ্টা সফল হলো।
বাংলাদেশের আম উৎপাদন ও রপ্তানির বর্তমান চিত্র
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট আম উৎপাদন হয়েছে প্রায় ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে মাত্র ১ হাজার ৩২১ টন আম রপ্তানি করা সম্ভব হয়েছে। গত বছর বাংলাদেশ থেকে আম রপ্তানি হয়েছে ২১টি দেশে, যার মধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ইতালি, সিঙ্গাপুর ও মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের আরও কিছু দেশ।
কেন গুরুত্বপূর্ণ চীনের বাজার?
চীন বিশ্বের বৃহত্তম আম আমদানিকারক দেশগুলোর একটি। বিশাল জনসংখ্যা, উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা এবং দ্রুত বর্ধনশীল সুপারমার্কেট চেইনের কারণে চীনের বাজারে প্রবেশ করা বাংলাদেশের কৃষক ও রপ্তানিকারকদের জন্য একটি গেম চেঞ্জার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
চীনে যেসব দেশ এর আগে আম রপ্তানি করত, তাদের মধ্যে রয়েছে ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও পাকিস্তান। এখন সেই তালিকায় যুক্ত হলো বাংলাদেশও।
যেভাবে প্রস্তুত হয়েছে রপ্তানিযোগ্য আম
চীনে আম রপ্তানির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ফাইটোস্যানিটারি স্ট্যান্ডার্ড, পেস্ট কন্ট্রোল, এবং হাইগিনিক প্যাকেজিং-এ। আম সংগ্রহের পর তা পরিষ্কার করে বিশেষ প্যাকেজিং এবং রেফ্রিজারেটেড কন্টেইনারে রপ্তানি উপযোগী করা হয়েছে।
জানা গেছে, সাতক্ষীরা ও যশোরের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারক এই প্রথম চালান প্রেরণে অংশ নিচ্ছেন। ভবিষ্যতে রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলের আমও চীনে পাঠানো হতে পারে।
অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও কৃষকের লাভ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের বাজারে ঢুকতে পারলে বাংলাদেশের আমের আন্তর্জাতিক মূল্য বাড়বে। এতে করে কৃষকও ন্যায্যমূল্য পাবেন। পাশাপাশি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয়ের ক্ষেত্রেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বর্তমানে দেশের মোট আম উৎপাদনের একটি ক্ষুদ্র অংশই রপ্তানি হয়। সেখান থেকে আগামী ৩-৫ বছরের মধ্যে অন্তত ১০ শতাংশ আম রপ্তানির লক্ষ্য নির্ধারণ করলে একটি বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি খাত গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ সরকারের কৃষি, বাণিজ্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয় চীনের পাশাপাশি জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নেও আম রপ্তানির পরিকল্পনা করছে। তবে এর জন্য দরকার আরও প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি ব্যবস্থাপনা, পেস্ট ও ডিজিজ কন্ট্রোল, এবং সার্টিফায়েড প্যাকেজিং ও হ্যান্ডলিং সেন্টার।
রপ্তানিকারকদের পক্ষ থেকেও কিছু চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- রপ্তানির জন্য সময়মতো চীন সরকারের সার্টিফিকেশন পাওয়া
- বিমানে পরিবহণ খরচ বেশি হওয়া
- হিমায়িত সংরক্ষণ কেন্দ্রের অভাব
আজকের এই আম রপ্তানির ঘটনা শুধু একটি বাণিজ্যিক সফলতা নয়, বরং বাংলাদেশের কৃষি রপ্তানিতে নতুন দিগন্তের সূচনা। সাতক্ষীরা ও যশোরের আম দিয়ে শুরু হলেও ভবিষ্যতে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের আমও চীনে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশের কৃষি খাত আন্তর্জাতিক বাজারে আরও সুসংহত অবস্থানে পৌঁছাতে পারবে।