ব্র্যাক ব্যাংকের এমডির পদত্যাগ

ব্র্যাক ব্যাংক পিএলসি, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের একটি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান, সম্প্রতি তার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম আর. এফ. হোসেনের পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছে। মঙ্গলবার (২৭ মে ২০২৫) ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে তিনি পদত্যাগ করেছেন বলে নিশ্চিত করেছেন। এই ঘোষণা ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে, যদিও সেলিম হোসেন জোর দিয়ে বলেছেন যে তার এই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত এবং এর পেছনে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক চাপ বা সমস্যা নেই।
পদত্যাগের পটভূমি
সেলিম আর. এফ. হোসেন ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে প্রায় এক দশক ধরে দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। তার নেতৃত্বে ব্র্যাক ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। ব্যাংকটি আধুনিক ব্যাংকিং সেবা, ডিজিটাল উদ্ভাবন এবং গ্রাহককেন্দ্রিক সেবার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে, ২৭ মে তিনি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালনা পর্ষদের কাছে তার পদত্যাগপত্র জমা দেন, যা পর্ষদ কর্তৃক গৃহীত হয়েছে। এই পদত্যাগপত্র এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হবে।
সেলিম হোসেন নিজেই জানিয়েছেন, “আমি বোর্ডের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছি, এবং বোর্ড তা গ্রহণ করেছে। এটি এখন বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হবে। আমি আশা করছি, বাংলাদেশ ব্যাংকও এটি গ্রহণ করবে।” তিনি আরও স্পষ্ট করেন যে তার এই সিদ্ধান্তের পেছনে কোনো অভ্যন্তরীণ সমস্যা বা চাপ নেই। “এটি সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। এখানে কোনো বাহ্যিক চাপ বা প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা নেই,” বলেন তিনি।
কর্মীদের উদ্দেশে চিঠি
পদত্যাগের ঘোষণার পর সেলিম আর. এফ. হোসেন ব্র্যাক ব্যাংকের কর্মীদের উদ্দেশে একটি আবেগঘন চিঠি লিখেছেন। চিঠিতে তিনি বলেন, “প্রিয় সহকর্মীরা, সব ভালো জিনিসেরই শেষ আছে, আর সেই ধারাবাহিকতায় ব্র্যাক ব্যাংকে আমার সময়েরও শেষ হতে চলেছে। আমি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালনা পর্ষদের কাছে আমার পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছি। কিছু আনুষ্ঠানিকতা ও প্রক্রিয়া এখনো বাকি রয়েছে, তবে আশা করি সেগুলো কোনো সমস্যা সৃষ্টি করবে না। আজই সম্ভবত আমার ব্র্যাক ব্যাংকে শেষ কর্মদিবস।”
তিনি তার চিঠিতে ব্যাংকের সঙ্গে তার দীর্ঘ যাত্রার কথা উল্লেখ করেন এবং বলেন, “গত প্রায় দশ বছর ধরে আপনাদের সঙ্গে কাজ করতে পারা আমার জন্য একটি বড় সম্মানের বিষয় ছিল। আমরা একসঙ্গে একটি অসাধারণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি, যা দেশের ব্যাংকিং খাতে এক অনুকরণীয় মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, ব্র্যাক ব্যাংক ভবিষ্যতেও উন্নতি অব্যাহত রাখবে এবং দেশের অর্থনীতি ও সমাজে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।”
চিঠিতে তিনি কর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং তাদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে সাফল্য কামনা করেন। তিনি লিখেন, “আপনাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে আগামী দিনে আরও সাফল্য ও অগ্রগতি কামনা করছি। আপনাদের এবং আপনাদের পরিবারের সুস্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধি কামনা করছি। অনুগ্রহ করে আমাকে ও আমার পরিবারকে আপনাদের প্রার্থনায় রাখবেন।”
ব্র্যাক ব্যাংকে সেলিম হোসেনের অবদান
সেলিম আর. এফ. হোসেনের নেতৃত্বে ব্র্যাক ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে। তার আমলে ব্যাংকটি ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, যার মধ্যে রয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং এবং গ্রাহকদের জন্য উন্নত সেবা প্রদান। এছাড়াও, ব্র্যাক ব্যাংকের এসএমই (ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ) ব্যাংকিং সেগমেন্টে তার নেতৃত্বে ব্যাপক প্রসার ঘটেছে, যা দেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অর্থায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
তার নেতৃত্বে ব্র্যাক ব্যাংক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। ব্যাংকটি গ্রাহক সেবা, ডিজিটাল উদ্ভাবন এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে। সেলিম হোসেনের দূরদর্শী নেতৃত্ব ব্যাংকটিকে একটি টেকসই এবং গ্রাহককেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
ব্যাংকিং খাতে প্রভাব
সেলিম আর. এফ. হোসেনের পদত্যাগ বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ব্র্যাক ব্যাংক দেশের শীর্ষ বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে একটি, এবং সেলিম হোসেনের নেতৃত্বে এটি ব্যাংকিং খাতে নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছে। তার পদত্যাগের পর ব্যাংকের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব এবং কৌশল নিয়ে স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে।
ব্যাংকিং বিশ্লেষকদের মতে, সেলিম হোসেনের পদত্যাগ ব্র্যাক ব্যাংকের দৈনন্দিন কার্যক্রমে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো বড় প্রভাব ফেলবে না, কারণ ব্যাংকটির একটি শক্তিশালী ব্যবস্থাপনা কাঠামো রয়েছে। তবে, নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ এবং তার নেতৃত্বে ব্যাংকের কৌশলগত দিকনির্দেশনা ভবিষ্যতে ব্যাংকের পারফরম্যান্সের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
সেলিম আর. এফ. হোসেন তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানাননি। তবে তিনি উল্লেখ করেছেন যে তার এই সিদ্ধান্ত ব্যক্তিগত কারণে নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকিং খাতের একজন অভিজ্ঞ নেতা হিসেবে তার পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে অনেকেই কৌতূহলী। কেউ কেউ মনে করছেন, তিনি হয়তো নতুন কোনো প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্বের ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেন বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে মনোনিবেশ করতে পারেন।
এদিকে, ব্র্যাক ব্যাংক জানিয়েছে যে তারা শীঘ্রই নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের পর সেলিম হোসেনের পদত্যাগ কার্যকর হবে, এবং এরপর ব্যাংক নতুন নেতৃত্বের অধীনে কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
উপসংহার
সেলিম আর. এফ. হোসেনের পদত্যাগ ব্র্যাক ব্যাংকের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। তার নেতৃত্বে ব্যাংকটি বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে একটি উল্লেখযোগ্য অবস্থান তৈরি করেছে। তার বিদায়ের মধ্য দিয়ে একটি যুগের সমাপ্তি ঘটলেও, তিনি যে ভিত্তি গড়ে দিয়েছেন, তা ব্র্যাক ব্যাংককে ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালীভাবে এগিয়ে যাওয়ার পথে সহায়তা করবে। তার পদত্যাগের কারণ সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত হলেও, ব্যাংকিং খাতে তার অবদান দীর্ঘদিন স্মরণীয় থাকবে।