বানিজ্য

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পণ্য রপ্তানির সম্ভাবনা

দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক বাণিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল হতে চলেছে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর প্রাকৃতিক সম্পদ, কাঁচামাল ও কৃষিপণ্যের বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশের জন্য এ বন্দর ব্যবহার করার সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদ প্রকাশ করেছেন দেশের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।

রাজধানীর বনানীতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চেম্বার (ICC Bangladesh) এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (ADB) আয়োজিত ‘অর্থনৈতিক করিডর ও অবকাঠামো উন্নয়ন’ শীর্ষক আলোচনায় এ সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন তিনি। আলোচনা সভায় দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারাও অংশ নেন।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও চট্টগ্রাম বন্দর: একটি সম্ভাবনার দিগন্ত

ড. মাহমুদ বলেন, “ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে রয়েছে প্রচুর বাঁশ, বেত ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ। এসব কাঁচামাল চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে এনে এই কাঁচামাল প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করলে উভয় দেশের জন্যই এটি উপকারী হবে।”

এই সম্ভাবনার বাস্তবায়ন হলে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে বাণিজ্যিক সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের হিন্টারল্যান্ড সম্প্রসারণ হবে ভারতের মেঘালয়, মিজোরাম, ত্রিপুরা ও আসাম রাজ্য পর্যন্ত।

কিন্তু সহজ নয় এই বাস্তবায়ন: ভূরাজনৈতিক প্রস্তুতির গুরুত্ব

এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত ভূরাজনৈতিক পরিবেশ। ড. মাহমুদ এ প্রসঙ্গে বলেন, “এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কূটনৈতিক সমঝোতা অত্যন্ত জরুরি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ চট্টগ্রাম বন্দর ঘিরে কয়েকটি কৌশলগত প্রকল্প গ্রহণ করেছে।”

ভারতের সঙ্গে সড়ক, রেল ও নদীপথে সংযোগ জোরদার করতে পারলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রপ্তানি-আমদানি কার্যক্রম আরও ত্বরান্বিত হবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ নিজেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য একটি বাণিজ্যিক ‘গেটওয়ে’ হয়ে উঠতে পারে।

অর্থনৈতিক করিডর উন্নয়ন ও অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জ

ড. মাহমুদ বলেন, “পর্যাপ্ত ও কার্যকর অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো না থাকলে বাইরের সঙ্গে সংযোগ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।” এ সময় তিনি অপচয়মূলক প্রকল্প গ্রহণের বিষয়ে সতর্কতা জারি করেন।

তিনি উল্লেখ করেন, “আমাদের উন্নয়ন বাজেটে বর্তমানে প্রায় ১,২০০টি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত, যার মধ্যে ৯৮-৯৯ শতাংশই আগের সরকারের হাতে নেওয়া। অধিকাংশ প্রকল্প ত্রুটিপূর্ণ নকশা বা অগ্রাধিকারহীনতার কারণে পর্যাপ্ত সুফল দিতে পারছে না।”

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, “গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্পের জন্য ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও নকশা ত্রুটির কারণে এখন এটি সম্পূর্ণ করতে আরও ৩ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হবে।”

চট্টগ্রাম বন্দর ঘিরে কৌশলগত পরিকল্পনার প্রয়োজন

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে হলে শুধু অবকাঠামো নয়, পরিকল্পনাভিত্তিক বাণিজ্যিক কৌশল গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তোলা, পণ্য সংরক্ষণের আধুনিক ব্যবস্থা, কাস্টমস ও শুল্ক প্রক্রিয়া সহজীকরণ ইত্যাদি প্রয়োজন।

এ বিষয়ে এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, “বর্তমানে গ্যাস সংকটের কারণে বিদ্যমান শিল্পকারখানাই চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা কঠিন।”

বিশ্বমানের অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও বিনিয়োগে ভাটা কেন?

ড. মাহমুদ বলেন, “পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত একটি এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু এর পরে কোনো কার্যকর সংযোগ না থাকায় ওই অঞ্চলে কাঙ্ক্ষিত বেসরকারি বিনিয়োগ আসেনি। শুধু অবকাঠামো থাকলেই হবে না, তা কার্যকরভাবে কাজে লাগানো জরুরি।”

এই প্রসঙ্গে সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, “আমরা বড় বড় অবকাঠামোকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি, কিন্তু ব্যবসার পরিবেশ উন্নত না করে এগোনো যাবে না। দেশের রপ্তানি একচেটিয়াভাবে তৈরি পোশাকনির্ভর, অথচ চামড়া ও অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ দীর্ঘদিন ধরে স্থবির।”

LDC উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ প্রস্তুতি নিয়ে মতভেদ

প্রধান উপদেষ্টার সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, “এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশের) তালিকা থেকে উত্তরণ নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। এটি নিয়ে এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত, নাকি সময় নেওয়া ভালো—এ নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে।”

তবে ভবিষ্যতের জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা ছাড়া বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি।

ব্যবসা সহজীকরণ ও টেকসই বিনিয়োগই ভবিষ্যতের চাবিকাঠি

এইচএসবিসি বাংলাদেশের সিইও মো. মাহবুব উর রহমান বলেন, “অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি ব্যবসা সহজীকরণ, আমদানি-রপ্তানির নিয়মতান্ত্রিকতা ও ব্যাংকিং কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।”

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “দেশে নতুন বিদেশি বিনিয়োগের হার আশানুরূপ নয়। যা আসছে, তা বেশির ভাগই পুনঃবিনিয়োগ।”

আঞ্চলিক করিডর গঠনে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত?

চট্টগ্রাম বন্দরকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রপ্তানির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করার চিন্তা নিঃসন্দেহে একটি কৌশলগত মাইলফলক হতে পারে। তবে এর সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সঠিক পরিকল্পনা, আধুনিক অবকাঠামো এবং ব্যবসা-বান্ধব নীতিমালা।

বাংলাদেশ যদি এই সুযোগকে কাজে লাগাতে পারে, তবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে চট্টগ্রাম বন্দর।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button