বানিজ্য

পণ্য খালাসে হচ্ছে বিলম্ব, ভোগান্তিতে ব্যবসায়ীরা

চট্টগ্রাম বন্দরের বহুল ব্যবহৃত টার্মিনালগুলোতে কনটেইনার ও কনটেইনারবাহী যানবাহনের দীর্ঘসূত্রতা ও জটের কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। গত কয়েক দিন ধরে বন্দরের অভ্যন্তরে ও সংলগ্ন এলাকায় চরমভাবে দৃশ্যমান এই অচলাবস্থা দেশের রপ্তানি ও আমদানি কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আমদানিকৃত পণ্য খালাসে বিলম্ব হওয়ার কারণে বিপুলসংখ্যক শিল্প প্রতিষ্ঠান কার্যত থমকে গেছে।

গত ১৯ মে চীনের শেকু বন্দর থেকে ছেড়ে আসা কনটেইনারবাহী জাহাজ ‘এমভি সান পেদ্রো’ বাংলাদেশের জলসীমায় পৌঁছালেও এখনও পর্যন্ত বন্দরের জেটিতে নোঙর করতে পারেনি। ছয় দিন ধরে জাহাজটি সাগরে ভাসছে, পণ্যের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছে না। পণ্য খালাসে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে উঠে এসেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চলমান আন্দোলন।

জাহাজটিতে এশিয়ান গ্রুপের ‘চিটাগাং এশিয়ান অ্যাপারেলস’-এর আমদানি করা কাপড় রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি এসব কাঁচামাল দিয়ে পোশাক তৈরি করে ইউরোপ ও আমেরিকায় রপ্তানি করে থাকে। কিন্তু সময়মতো কাঁচামাল খালাস না হওয়ায় তারা এখন রপ্তানি সময়সূচি মেনে চলতে পারবে কি না, তা নিয়ে দারুণ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ সালাম বলেন, “পোশাক তৈরির জন্য আমাদের হাতে সাধারণত ২০-২৫ দিনের সময় থাকে। সেখানে এখন কাঁচামাল খালাসেই যদি ১০-১২ দিন লেগে যায়, তাহলে পণ্য সময়মতো উৎপাদন করে বিদেশি ক্রেতার কাছে পাঠানো সম্ভব নয়। রপ্তানির সময়সীমা মেটাতে বাধ্য হয়ে উড়োজাহাজে পাঠাতে হতে পারে, কিন্তু তার খরচ বহন করা আমাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন।”

এটি শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের সমস্যা নয়। এমভি সান পেদ্রো নামের এই একটি জাহাজেই রয়েছে দেশের ২৯৮টি প্রতিষ্ঠানের আমদানি পণ্য—প্রধানত রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল। এ ধরনের আরও অন্তত ১৫টি জাহাজ দীর্ঘ সময় ধরে বন্দরের বাইরে সাগরে অপেক্ষমাণ। এসব জাহাজে থাকা পণ্যের মালিক চার হাজারেরও বেশি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান।

চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারী ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর ভাষ্যমতে, চট্টগ্রাম বন্দরে এই অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে মূলত কাস্টমস কর্মকর্তাদের কলমবিরতির কারণে। এনবিআরের কাঠামোগত সংস্কারের প্রতিবাদে ১৪ মে থেকে শুরু হয় আন্দোলন, যার অংশ হিসেবে ১৮ মে থেকে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতিতে যান কাস্টমস কর্মকর্তারা। সরকারের পক্ষ থেকে ১২ মে জারি করা এক অধ্যাদেশে এনবিআর বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে দুটি নতুন বিভাগ গঠন করা হয়। এই সিদ্ধান্তকেই আন্দোলনের মূলে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস হলো দেশের সবচেয়ে বড় কাস্টমস স্টেশন। দেশের মোট আমদানি পণ্যের প্রায় ৯৫ শতাংশ এই কাস্টম হাউসের মাধ্যমে শুল্কায়ন হয়। আবার জাতীয় পর্যায়ে আমদানি-রপ্তানি পণ্যের প্রায় ৭৯ শতাংশ আসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই। ফলে এই কাস্টম হাউসের স্থবিরতা পুরো আমদানি-রপ্তানি চেইনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমে বড় ধরনের ব্যাঘাত তৈরি হওয়ায় ক্ষতির পরিমাণ প্রতিদিনই বাড়ছে। বন্দর সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রতিটি বিলম্বিত জাহাজের জন্য অতিরিক্ত ডেমারেজ ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ গুনতে হচ্ছে আমদানিকারকদের। এছাড়া সময়মতো পণ্য না পৌঁছানোয় আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের সঙ্গে দেশের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর চুক্তি ভঙ্গ হচ্ছে, যার ফলে আর্থিক জরিমানা ও ভবিষ্যৎ ব্যবসা হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, “এই পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে আমাদের রপ্তানি কার্যক্রমে মারাত্মক ধাক্কা লাগবে। অনেক প্রতিষ্ঠান উৎপাদন স্থগিত করতে বাধ্য হচ্ছে, যা হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থানের জন্য হুমকি হতে পারে।”

অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, গতকাল (২৪ মে) রাতে আন্দোলনকারী কর্মকর্তারা কর্মসূচি স্থগিত করার ঘোষণা দিলেও তার বাস্তব প্রভাব বন্দরে পড়তে আরও কয়েক দিন সময় লাগবে। কারণ কনটেইনার খালাস ও শুল্কায়ন প্রক্রিয়া পুরোদমে শুরু না হলে জমে থাকা পণ্য খালাসে সময় লাগবে।

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, “সরকারের যেকোনো নীতিগত পরিবর্তনে স্বচ্ছতা ও সময়োপযোগিতা থাকা জরুরি। কিন্তু এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় যদি পুরো বন্দর অচল হয়ে পড়ে, তবে সেটি জাতীয় অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। সরকারের উচিত দ্রুত সমাধান নিশ্চিত করে কাস্টমস কার্যক্রম স্বাভাবিক করা।”

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “জেটিতে জাহাজ নোঙরের জায়গা আছে, কিন্তু কাস্টমস প্রক্রিয়া না থাকায় জাহাজগুলোকে ছুটিতে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিটি মুহূর্তে বন্দরে চাপ বাড়ছে।”

সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত সংকট নিরসনে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানানো হলেও ব্যবসায়ী মহলের মধ্যে আস্থাহীনতা বিরাজ করছে। তাঁরা চাইছেন, এই সমস্যা স্থায়ীভাবে সমাধানের জন্য একটি স্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করা হোক।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, কেবল আমদানি নয়—রপ্তানির দিক থেকেও এই অচলাবস্থা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিদেশগামী কনটেইনার সময়মতো বন্দরে প্রবেশ করতে না পারায় বহু রপ্তানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের এই স্থবিরতা যদি দ্রুত সময়ের মধ্যে নিরসন না করা যায়, তবে তা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিল্পোৎপাদন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে ফেলতে পারে। সংশ্লিষ্ট মহলের প্রত্যাশা, সরকার ও কাস্টমস বিভাগ দ্রুত সমঝোতায় পৌঁছে এ সংকট থেকে উত্তরণের পথ সুগম করবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button