বানিজ্য

চট্টগ্রাম বন্দরে ২৪ হাজার কনটেইনার নিয়ে ভাসছে ১৭ জাহাজ

চট্টগ্রাম বন্দরে ক্রমবর্ধমান জাহাজজট ও কনটেইনার সংকট ব্যবসায়ীদের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কনটেইনারবাহী গাড়িচালকদের বারবার কর্মসূচি এবং কাস্টমস কর্মকর্তা–কর্মচারীদের কলমবিরতির প্রভাবে বন্দরে পণ্য খালাসের প্রক্রিয়া মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ফলে, জলসীমায় পৌঁছানো জাহাজগুলো জেটিতে ভিড়তে পাঁচ থেকে ছয় দিন সময় নিচ্ছে, যা ব্যবসায়ীদের পণ্য হাতে পাওয়ার অপেক্ষার সময়কে আরও দীর্ঘ করছে। বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, শনিবার সকাল পর্যন্ত ১৭টি জাহাজে প্রায় ২৪ হাজার একক কনটেইনার অপেক্ষারত ছিল। এই সংকটের প্রভাবে বিশেষ করে পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।

জাহাজজটের কারণ ও পরিস্থিতি

চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজজটের সমস্যা নতুন নয়। তবে গত কয়েক মাসে কনটেইনারবাহী গাড়িচালকদের একাধিক কর্মসূচি এই জটকে আরও জটিল করেছে। সর্বশেষ ১৫ মে, ১২ ঘণ্টার কর্মসূচি পালনের ফলে জাহাজ থেকে কনটেইনার নামানো এবং রপ্তানির জন্য কনটেইনার জাহাজে তোলার কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। এতে একদিনেই বন্দরে চারটি জাহাজের জট তৈরি হয়।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্তির অধ্যাদেশ জারির প্রতিবাদে কাস্টমস কর্মকর্তা–কর্মচারীদের চলমান কলমবিরতি। ১৪ মে থেকে শুরু হওয়া এই কর্মসূচির কারণে শুল্কায়ন ও পণ্য পরীক্ষণ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ফলে জাহাজ থেকে কনটেইনার খালাসের গতি কমে গেছে। বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বন্দর চত্বরে মাত্র ১০ হাজার একক কনটেইনার রাখার স্থান রয়েছে, যা বর্তমানে অপেক্ষারত ২৪ হাজার কনটেইনারের তুলনায় অনেক কম। এই স্থান সংকটের কারণে জাহাজগুলো জেটিতে ভিড়তে দেরি করছে।

শনিবার সকালে ২২টি জাহাজ জেটিতে ভেড়ার অপেক্ষায় ছিল। জোয়ারের সময় পাঁচটি জাহাজ জেটিতে ভিড়তে পারলেও বাকি ১৭টি জাহাজ এখনো অপেক্ষায় রয়েছে। এই জাহাজগুলোতে থাকা ২৪ হাজার কনটেইনার খালাসের জন্য পর্যাপ্ত স্থান না থাকায় পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে।

পোশাকশিল্পে প্রভাব

চট্টগ্রাম বন্দরের এই সংকটের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হচ্ছেন পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের স্থগিতাদেশ শেষ হওয়ার আগে রপ্তানি করতে হলে দ্রুত কাঁচামাল হাতে পাওয়া জরুরি। কিন্তু বন্দরে আটকে থাকা কাঁচামালের কারণে উৎপাদন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে। ফলে রপ্তানির সময়সীমা মেনে চলতে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)-এর সাবেক প্রথম সহসভাপতি এস এম আবু তৈয়ব বলেন, “এনবিআরের কর্মকর্তাদের কলমবিরতির প্রভাব বন্দরের কার্যক্রমে পড়ছে। এতে পোশাকশিল্পে বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। কাঁচামাল হাতে পেতে ছয় দিনের বেশি সময় লাগছে, যা আগে ছিল না। আসন্ন ঈদের ছুটির কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।”

তিনি আরও বলেন, “ট্রাম্পের শুল্ক স্থগিতাদেশের মধ্যে রপ্তানি করতে হলে দ্রুত উৎপাদন জরুরি। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তা সম্ভব হচ্ছে না। এতে রপ্তানি খাতে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।”

কাস্টমস কর্মসূচির প্রভাব

কাস্টমস কর্মকর্তা–কর্মচারীদের কলমবিরতি শুধু আমদানি কEenা কার্যক্রমে প্রভাব ফেলছে না, বরং বন্দরের সামগ্রিক কার্যক্রমকেও মন্থর করে দিয়েছে। শনিবার বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে কোনো কার্যক্রম পরিচালিত হয়নি। সরেজমিনে দেখা গেছে, শুল্কায়নের কক্ষগুলোতে কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন না। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা নথিপত্র নিয়ে অপেক্ষা করলেও তাঁদের কাজ এগোয়নি।

এই কর্মসূচির ফলে শুল্কায়ন ও পণ্য পরীক্ষণ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকায় কনটেইনার খালাস সম্ভব হচ্ছে না। ফলে জাহাজ থেকে কনটেইনার নামানোর কার্যক্রমও ধীরগতির হয়ে পড়েছে। বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, কলমবিরতির আগে বন্দরে ৩৭ হাজার একক কনটেইনার খালাসের অপেক্ষায় ছিল। বৃহস্পতিবার সকালে তা বেড়ে ৪৩ হাজারে পৌঁছায়। শুক্রবার কিছু কনটেইনার খালাস হলেও শনিবারের কর্মসূচির কারণে এই সংখ্যা আবার বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বন্দর কর্তৃপক্ষের বক্তব্য

চট্টগ্রাম বন্দরের মুখপাত্র মো. নাসির উদ্দিন বলেন, “বন্দর ২৪ ঘণ্টা সচল রয়েছে। তবে বন্দরের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত না হলেও বিভিন্ন কর্মসূচির কারণে কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি যাতে জট কমানো যায়।” তিনি আরও বলেন, “বন্দরের স্থান সংকট এবং কাস্টমসের কর্মসূচির কারণে পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। তবে আমরা সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।”

সম্ভাব্য সমাধান ও ভবিষ্যৎ

বন্দরের এই সংকট সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কাস্টমস কর্মকর্তাদের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে তাঁদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করানো এবং কনটেইনার পরিবহনের জন্য অতিরিক্ত স্থান বরাদ্দ করা জরুরি। এছাড়া, ঈদের ছুটির আগে জট কমাতে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

বন্দরের এই সংকট কেবল পোশাকশিল্প নয়, বাংলাদেশের সামগ্রিক রপ্তানি খাতের ওপর প্রভাব ফেলছে। দ্রুত সমাধান না হলে দেশের অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button