ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স প্রক্রিয়া পুনর্বিবেচনা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স প্রদান প্রক্রিয়া পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শনিবার (২৪ মে) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)-এর ক্রেডিট বর্ধিতকরণ প্রকল্প (সিইএস) উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ ঘোষণা দেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ. মনসুর। তিনি জানান, পূর্বের লাইসেন্স প্রদান প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার ঘাটতি ছিল, যা পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে সংশোধন করা হবে। তবে, পূর্বে প্রদত্ত লাইসেন্স বাতিলের বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
গভর্নর আরও বলেন, দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ দিয়ে বিদেশে গড়ে তোলা সম্পদ ফ্রিজ করতে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোর সহযোগিতা ইতিবাচক। এসব সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনতে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি, অন্যান্য দেশে এই সম্পদ বিক্রির পথ বন্ধ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ করে যাচ্ছে। তিনি জানান, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে অর্থ পাচারের ঘটনাগুলো আরও প্রকাশিত হবে, তবে এসব সম্পদ ফেরত আনতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা অব্যাহত থাকা অপরিহার্য।
ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে স্বচ্ছতার প্রয়োজনীয়তা
ড. আহসান এইচ. মনসুর জানান, ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রযুক্তিনির্ভর তরুণদের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এটি শহর-গ্রাম নির্বিশেষে এমন অনেক মানুষের জন্য ব্যাংকিং সুবিধা নিশ্চিত করবে, যারা এখনও মূলধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে রয়েছেন। তবে, তিনি সতর্ক করে বলেন, নীতিমালা ছাড়া ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স প্রদান গ্রাহকদের ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। এজন্য দ্রুত একটি শক্তিশালী নীতি কাঠামো তৈরি এবং সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করা প্রয়োজন। “নীতি কাঠামো ছাড়া ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করলে হাওয়ায় টাকা হাওয়া হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে,” বলেন তিনি।
গভর্নরের মতে, পূর্ববর্তী লাইসেন্স প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব ছিল, যা ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা কমিয়ে দিয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, নগদ ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে এবং এটি পুনরায় পর্যালোচনা করা হবে। যোগ্যতার ভিত্তিতে লাইসেন্স পুনর্বহাল করা হতে পারে। এছাড়া, নগদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার ও অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
অর্থ পাচার রোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ
অর্থ পাচারের ঘটনাগুলো নিয়ে গভর্নর বলেন, এই সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি জানান, বিদেশে পাচার করা অর্থের সম্পদ ফ্রিজ করতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে কাজ চলছে। এসব সম্পদ বিক্রি বন্ধ করতে এবং দেশে ফিরিয়ে আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তৎপর রয়েছে। তবে, তিনি সতর্ক করে বলেন, এই প্রক্রিয়া সফল করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। “যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকে, তবে এই সম্পদ ফেরত আনা সম্ভব হবে না,” তিনি মন্তব্য করেন।
এছাড়া, তিনি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন, এই ঘটনাগুলো প্রকাশের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন কিছু ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন করেছে, যেখানে অনিয়মের অভিযোগ ছিল। এই পদক্ষেপগুলো অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ।
ক্ষুদ্র ঋণ খাতে প্রতিযোগিতা ও টেকসই উন্নয়ন
অনুষ্ঠানে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে গভর্নর বলেন, ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বাজারে টিকে থাকা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি জানান, ২৬ শতাংশ সুদের হারে ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যদি ব্যাংকের ১৪ শতাংশ সুদের হারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারে, তবে তারা বাজার থেকে ছিটকে যাবে। এই প্রেক্ষাপটে তিনি ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের কার্যক্রম আরও দক্ষ ও গ্রাহকবান্ধব করার পরামর্শ দেন।
তিনি আরও বলেন, ক্ষুদ্র ঋণ খাত দেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই খাতের মাধ্যমে গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে আর্থিক সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। তবে, এই খাতের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সঠিক নীতিমালা ও তদারকি অপরিহার্য। গভর্নরের মতে, ক্যাশলেস লেনদেন বাড়ানো এবং আনুষ্ঠানিক খাতে আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হলে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে, যা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক।
ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থা বাংলাদেশের আর্থিক খাতে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। গভর্নরের মতে, এই ব্যবস্থা ২৪ ঘণ্টা ব্যাংকিং সুবিধা প্রদানের পাশাপাশি গ্রাহকদের সময় ও খরচ সাশ্রয় করবে। তবে, তিনি সতর্ক করে বলেন, নীতিমালা ছাড়া এই ব্যবস্থা চালু করলে গ্রাহকদের আর্থিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। এজন্য সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা এবং একটি শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।
এছাড়া, তিনি ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধির সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেন। গ্রামীণ এলাকার মানুষ, যারা এখনও ব্যাংকিং সেবার আওতায় আসেনি, তারা ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আর্থিক সুবিধা পেতে পারে। তবে, এই সুবিধা নিশ্চিত করতে প্রযুক্তিগত অবকাঠামো উন্নয়ন এবং গ্রাহক শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন।
অর্থনৈতিক সংস্কারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা
ড. আহসান এইচ. মনসুর জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তিনি বলেন, দুর্ঘটনা কবলিত অর্থনীতি পুনর্গঠনে একটি অর্থনৈতিক বিপ্লব প্রয়োজন। এজন্য জুলাই বিপ্লবকে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী করতে হবে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে হবে। তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে কয়েকটি ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন করেছে এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে।
গভর্নরের মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি আংশিক পুনর্গঠিত অবস্থায় রয়েছে। এটি একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে তুলে দিতে হবে, যারা এই অর্থনীতিকে আরও সুন্দরভাবে সামনের দিকে নিয়ে যাবে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব, তবে এজন্য সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
উপসংহার
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ. মনসুরের ঘোষণা ডিজিটাল ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করে। অর্থ পাচার রোধ, ক্ষুদ্র ঋণ খাতের উন্নয়ন, এবং ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের নীতি কাঠামো প্রণয়নের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। তবে, এই লক্ষ্য অর্জনে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।