চার দফা দাবিতে এনবিআর কর্মকর্তাদের নতুন কর্মসূচি

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) কর্মরত কর্মকর্তারা চার দফা দাবিতে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। দাবি আদায়ে ব্যর্থ হলে আগামী ২৬ মে সোমবার থেকে আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা ব্যতীত এনবিআরের সব কার্যক্রম বন্ধ রেখে দেশব্যাপী কর্মবিরতি পালন করা হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন তারা।
শনিবার (২৪ মে) বিকেলে রাজধানীর এনবিআর ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচি ঘোষণা করে ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’। সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ২৫ মে রবিবার থেকেই রপ্তানি এবং আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা ছাড়া অন্য সকল কার্যক্রমে কর্মবিরতি শুরু হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা দাবি করেন, তাদের দাবিগুলো দীর্ঘদিন ধরেই উপেক্ষিত থেকে আসছে। এতে এনবিআরের কর্মপরিবেশ, কর্মীদের ন্যায্য অধিকার এবং রাজস্ব প্রশাসনের সার্বিক দক্ষতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
চার দফা দাবি কী কী?
এনবিআর কর্মকর্তাদের চার দফা দাবির মূল বিষয়গুলো হলো:
- পদোন্নতি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও নিয়মিততা নিশ্চিত করা।
- প্রশাসনিক কাঠামো সংস্কার এবং কর প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ।
- ট্যাক্স কর্মকর্তাদের জন্য পৃথক ক্যাডার গঠন।
- আধুনিক কর ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার।
এই দাবিগুলোর যৌক্তিকতা তুলে ধরে এনবিআরের অতিরিক্ত কমিশনার এদিব বিল্লাহ বলেন, “দাবি বাস্তবায়নের জন্য বারবার আহ্বান জানানো হলেও কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আমরা সংলাপে বিশ্বাসী, তবে দীর্ঘদিন ধরে অবহেলার শিকার হয়ে এখন কর্মসূচি দিতে বাধ্য হয়েছি।”
চেয়ারম্যানের বৈঠক ঘিরে উত্তেজনা
শনিবার সকাল সাড়ে ৯টায় এনবিআর ভবনে এনবিআর চেয়ারম্যানের পূর্বনির্ধারিত বৈঠকের খবরে সকাল থেকেই ফটকে অবস্থান নেন আন্দোলনকারী কর্মকর্তারা। বৈঠকে অংশ নেওয়ার আগে তারা দাবি বাস্তবায়নের বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়ার চেষ্টা করেন।
বৈঠককেন্দ্রিক টানাপোড়েনের মধ্যেই দুপুর দেড়টার দিকে যৌথবাহিনী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে আসে, যা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন আন্দোলনকারীরা।
তারা অভিযোগ করেন, যৌথবাহিনীর উপস্থিতি আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে এবং এতে স্বাভাবিক কর্মসূচি বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
প্রশাসনিক সংস্কারের ওপর জোর
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত উপ-কর কমিশনার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “দেশে ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত উল্লেখযোগ্যভাবে কম। রাজস্ব আদায়ের হার বাড়াতে হলে শুধুমাত্র ভর্তুকি বা কর হার বাড়ানো নয়, বরং প্রশাসনিক সংস্কার জরুরি।”
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে এনবিআর-এর কাঠামো সময়োপযোগী নয় এবং এটি আধুনিক রাজস্ব ব্যবস্থাপনার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না।
তিনি জোর দেন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি ও প্রশিক্ষণে দীর্ঘসূত্রতা, স্বজনপ্রীতি এবং রাজনৈতিক প্রভাব প্রশাসনের স্বাভাবিক কাজকে বাধাগ্রস্ত করছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীরবতা
২২ মে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করা হলেও কোনো ধরনের সমঝোতা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের নেতারা বলেন, বিষয়টি শুধু কর্মকর্তাদের স্বার্থ নয়, এটি রাজস্ব খাতের ভবিষ্যতের প্রশ্ন। তাই সরকারকে অবিলম্বে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
পরবর্তী কর্মসূচির হুমকি
সংগঠনের নেতারা জানিয়েছেন, দাবি আদায় না হলে ২৬ মে থেকে দেশব্যাপী কঠোর কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
তারা বলেন, আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা বাদে এনবিআরের সব কার্যক্রম বন্ধ থাকবে এবং এতে সারা দেশের রাজস্ব আদায় কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।
তবে তারা সরকারকে এখনও আলোচনার সুযোগ দিচ্ছেন বলে জানিয়ে বলেন, সরকারের সদিচ্ছা থাকলে সমস্যা সমাধান সম্ভব।
বিশ্লেষণ: রাজস্ব ব্যবস্থায় সংস্কার কতটা জরুরি?
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এনবিআরের অভ্যন্তরীণ সমস্যা ও প্রশাসনিক অদক্ষতা রাজস্ব আদায়ে বড় অন্তরায়। দেশের কর আদায় ব্যবস্থা আধুনিকায়নের জন্য কর কর্মকর্তাদের স্বচ্ছ নিয়োগ, দক্ষতা উন্নয়ন ও উৎসাহ প্রদানের ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
বর্তমানে ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৮.৮ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এটি সর্বনিম্ন। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় এনবিআরের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তবে, আন্দোলনের পথ পরিহার করে আলোচনার মাধ্যমে দাবি বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক দক্ষতা বাড়ানো উচিত বলেই মনে করেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।
উপসংহার
এনবিআর কর্মকর্তাদের এই আন্দোলন শুধুমাত্র চাকরি সংক্রান্ত দাবি নয়, বরং এটি দেশের রাজস্ব ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নের প্রশ্নে আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে। কর্মবিরতি অব্যাহত থাকলে দেশের রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ধাক্কা লাগতে পারে।
সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে দাবি বাস্তবায়নের একটি বাস্তবসম্মত রূপরেখা তৈরি করা।