আখাউড়া দিয়ে ফের শুরু মাছ রপ্তানি, ভারতীয় নিষেধাজ্ঞায় বিপাকে অন্যান্য পণ্য

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ফের শুরু হয়েছে হিমায়িত মাছ রপ্তানি। দীর্ঘদিনের পারমিট জটিলতা কাটিয়ে বৃহস্পতিবার (২৩ মে) সকাল সাড়ে ১১টায় ১০টি গাড়িতে করে প্রায় ৭০ টন মাছ পাঠানো হয়েছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায়।
মাছ রপ্তানির পাশাপাশি সকালেই আখাউড়া থেকে ৯০ টন পাথর এবং ১০৬ টন ভোজ্যতেলও ভারতে রপ্তানি হয়েছে। তবে এই রপ্তানির মধ্যেই ছায়া ফেলেছে ভারতের সাম্প্রতিক এক নিষেধাজ্ঞা, যা বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
ইএক্সপি জটিলতা কাটিয়ে স্বস্তি মাছ রপ্তানিকারকদের
আখাউড়া স্থলবন্দরের সহকারী পরিচালক মাহমুদুল হাসান নিশ্চিত করেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ইএক্সপি (Export Permit – EXP) সংক্রান্ত জটিলতা দূর হওয়ায় বৃহস্পতিবার থেকে ফের মাছ রপ্তানি শুরু হয়েছে।
মৎস্য রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. ফারুক মিয়া বলেন,
“বাংলাদেশ ব্যাংকের ইএক্সপি ছাড়পত্র ছাড়া মাছ ভারতে রপ্তানি করা যায় না। গতকাল বুধবার এই ছাড়পত্র হাতে না আসায় আমাদের রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ ছিল। আজ সকালে কাগজ হাতে পেয়েই রপ্তানি শুরু করা গেছে।”
এদিকে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, আখাউড়া বন্দর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৫০-৬০ টন হিমায়িত মাছ রপ্তানি হয়, যার বেশিরভাগই ত্রিপুরা হয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে যায়।
ভারতীয় নিষেধাজ্ঞায় নতুন শঙ্কা
তবে মাছ রপ্তানি চালু হলেও ভারতের হঠাৎ জারি করা নতুন নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের অন্যান্য রপ্তানি পণ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার স্থলপথে বাংলাদেশ থেকে ৬টি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এই পণ্যগুলো হলো:
- তৈরি পোশাক
- ফল ও ফলের স্বাদযুক্ত পানীয়
- প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য
- প্লাস্টিক সামগ্রী
- সুতা ও সুতার উপজাত
- আসবাবপত্র
এদের মধ্যে তৈরি পোশাক ও কাঠের আসবাব ব্যতীত বাকি পণ্যগুলো আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে নিয়মিত রপ্তানি হতো। নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ায় এসব পণ্যের রপ্তানি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে, ফলে স্থবির হয়ে পড়েছে বন্দরের কার্যক্রম।
রপ্তানি প্রবৃদ্ধির মাঝেই বাধা
আখাউড়া শুল্ক স্টেশন সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই স্থলবন্দর দিয়ে ৪২৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকার পণ্য রপ্তানি হয়েছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসেই রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৫৩ কোটি ১ লাখ টাকা।
রপ্তানির প্রধান পণ্য ছিল হিমায়িত মাছ, রড, সিমেন্ট, প্লাস্টিক, ভোজ্যতেল, তুলা, প্রক্রিয়াজাত খাবার, মেলামাইন সামগ্রী ও শুঁটকি মাছ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আখাউড়া বন্দর ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিশেষ করে ত্রিপুরায় বাংলাদেশের পণ্য সরবরাহের অন্যতম প্রধান পথ। নতুন নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘমেয়াদে বহুমুখী প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়লেও ভারতের নিষেধাজ্ঞা তার গতি থামিয়ে দিতে পারে।
প্রতিদিন ৪৫ লাখ টাকার ক্ষতি
আখাউড়া স্থলবন্দরের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, হিমায়িত মাছের পর সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হতো প্লাস্টিক পণ্য, পিভিসি সামগ্রী, বিস্কুট, চিপস ও ফলের স্বাদযুক্ত জুস। প্রতিদিন প্রায় ৪০-৪৫ লাখ টাকার পণ্য এসব ক্যাটাগরিতে ভারতে যেত।
নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার পর এসব রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে, ফলে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।
ব্যবসায়ী মঈন উদ্দিন বলেন,
“আমাদের পণ্য প্যাকিং, কন্টেইনার ভাড়া, লেবার খরচ—সবই আগেই হয়ে গেছে। এখন ভারত যদি ঢুকতে না দেয়, তাহলে এসব ক্ষতি কে দেবে?”
পরবর্তী করণীয় কী?
বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
“আমরা ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। এই নিষেধাজ্ঞার যৌক্তিকতা জানতে চাওয়া হয়েছে। বিশেষ করে যেসব পণ্য দীর্ঘদিন ধরে নির্বিঘ্নে রপ্তানি হচ্ছিল, সেগুলো হঠাৎ করে নিষিদ্ধ করার পেছনে কোনো স্বাস্থ্য বা নিরাপত্তা-সংক্রান্ত কারণ থাকলে তা জানা দরকার।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্ক এতটাই ঘনিষ্ঠ যে, এমন হঠাৎ নিষেধাজ্ঞা দুই দেশেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশেষ করে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে বাংলাদেশের মাছ, ভোজ্যতেল, সিমেন্ট ও প্রক্রিয়াজাত খাবারের ওপর ব্যাপক নির্ভরতা রয়েছে।
বাংলাদেশের আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে মাছ রপ্তানির পুনরায় শুরু দেশের অর্থনীতির জন্য অবশ্যই ইতিবাচক খবর। তবে ভারত সরকারের হঠাৎ রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘমেয়াদে এই বন্দরভিত্তিক বাণিজ্যে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
যথাযথ কূটনৈতিক উদ্যোগ, যৌথ বাণিজ্য আলোচনা ও পারস্পরিক স্বার্থ বিবেচনায় দুই দেশকেই সমাধানে আসতে হবে—না হলে আখাউড়া বন্দরের মতো সম্ভাবনাময় প্রবেশদ্বার থেকেও আমরা প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে পারি।