বানিজ্য

চীনে বাংলাদেশি আম রপ্তানি শুরু, খুলছে কৃষিপণ্যের নতুন দুয়ার

বাংলাদেশের কৃষিখাতে যুক্ত হলো এক নতুন সাফল্য। চলতি মে মাসেই প্রথমবারের মতো চীনের বাজারে রপ্তানি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশি আম। দীর্ঘ প্রস্তুতি, নানা মান পরীক্ষণ এবং চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনার পর অবশেষে বাস্তবে রূপ নিচ্ছে বহুপ্রতীক্ষিত এই উদ্যোগ। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এটি দেশের ফল রপ্তানির ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, যা ভবিষ্যতে কৃষক, রপ্তানিকারক এবং বৈদেশিক মুদ্রার জন্য বড় সুযোগ এনে দেবে।

দীর্ঘ প্রস্তুতির পর চীনের বাজারে প্রবেশ

গত ২১ মে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান জানান, চলতি আম মৌসুমেই প্রথম চালান চীনের উদ্দেশে পাঠানো হবে। এ উদ্যোগের পেছনে রয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, বেসরকারি রপ্তানিকারক এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সম্মিলিত পরিশ্রম।

সদ্য সমাপ্ত চীন সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই রপ্তানি উদ্যোগে বড় অগ্রগতি এনে দেন। সফরে চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার পরই বাংলাদেশের আম রপ্তানির অনুমোদন চূড়ান্ত হয়।

কী ধরনের আম যাবে চীনে?

সূত্র জানায়, চীনে রপ্তানির জন্য নির্বাচিত হয়েছে ‘হিমসাগর’ ও ‘ল্যাংড়া’ জাতের আম, যেগুলো স্বাদ, সুগন্ধ এবং গুণগত মানের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ জনপ্রিয়। চীনের খাদ্য সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ (GACC) বাংলাদেশি আম রপ্তানির জন্য নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করেছে কি না তা নিশ্চিত করতে বেশ কয়েকবার পরিদর্শনও করেছে। মান রক্ষা, পেস্ট কন্ট্রোল, হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট এবং ফুড গ্রেড প্যাকেজিংয়ের মতো বিষয়গুলো শতভাগ মেনে চলার নির্দেশনা দিয়েছে তারা।

চাষিদের প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি

আম রপ্তানির এ বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশের আম উৎপাদক চাষিদের দেওয়া হয়েছে বিশেষ প্রশিক্ষণ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও সাতক্ষীরার প্রায় ২,০০০ আম চাষিকে রপ্তানিযোগ্য আম চাষ, পরিচর্যা, ফল সংগ্রহ ও প্যাকেজিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

রপ্তানি উপযোগী আম চাষের জন্য চাষিদের ‘গ্লোবাল গ্যাপ (Global GAP)’ মানদণ্ডে অভ্যস্ত করা হয়েছে। এতে কীটনাশকের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ, বাছাইকৃত গাছ থেকে আম সংগ্রহ, ফসলের ট্রেসিবিলিটি (traceability) নিশ্চিত করা হয়েছে।

রপ্তানির অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

বাংলাদেশে বছরে প্রায় ২৭ লাখ টন আম উৎপন্ন হয়। এর একটি অংশ বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব বলে মনে করছে সরকার। কৃষিসচিব বলেন, “আমাদের লক্ষ্যমাত্রা, আগামী ৩ বছরে বছরে কমপক্ষে ২৫,০০০ টন আম রপ্তানি করা। এতে বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় সম্ভব।”

ভারত, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও এখন চীনকে গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনাময় বাজার হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ। বিশাল জনসংখ্যার এই দেশে উচ্চমানসম্পন্ন ফলের চাহিদা বাড়ছে, যা বাংলাদেশের জন্য বড় সুযোগ।

আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষি রূপান্তর

সচিব জানান, কৃষি খাতকে আরও আধুনিক ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর করতে সরকার কাজ করছে একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরির ওপর। দেশের প্রতিটি কৃষি প্লটকে একটি সমন্বিত ডেটাবেসে অন্তর্ভুক্ত করে তৈরি হচ্ছে একটি মোবাইল অ্যাপ ‘খামারি’, যার মাধ্যমে কৃষকরা জানতে পারবেন:

  • কোন মৌসুমে কোন ফসল ভালো হবে
  • কী ধরনের সার বা বালাইনাশক প্রয়োজন
  • আবহাওয়া তথ্য ও রোগবালাই সতর্কতা
  • ফল কাটা ও সংরক্ষণের আধুনিক কৌশল

এছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সব প্রতিষ্ঠানকে একীভূত করে একটি ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (MIS) চালু করা হচ্ছে, যা মাঠপর্যায়ের তথ্য ও পরিষেবার গতি বাড়াবে।

নারী ও তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ

প্রেস ব্রিফিংয়ে কৃষিসচিব আরও জানান, নারী ও তরুণদের কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে সরকার একটি দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি নিয়েছে। এতে প্রশিক্ষণ, সহজ শর্তে কৃষিঋণ, বাজার সংযোগ ও প্রযুক্তি সহায়তা দেওয়া হবে। একইসঙ্গে বেসরকারি খাতের সঙ্গে অংশীদারিত্ব বাড়িয়ে আরও দক্ষ কর্মশক্তি তৈরি করা হবে।

ফল সংরক্ষণে আধুনিক হিমাগার নির্মাণ

শুধু আম নয়, ভবিষ্যতে কাঁঠাল, লিচু ও অন্যান্য মৌসুমি ফলও বিদেশে রপ্তানির লক্ষ্যে সরকার আধুনিক হিমাগার নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। বর্তমানে পচনশীল ফল ও সবজি সংরক্ষণের পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকায় উৎপাদিত ফসলের একটি বড় অংশ নষ্ট হয়ে যায়। নতুন হিমাগারগুলো স্থাপন করা হবে রাজশাহী, যশোর, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামে, যেখানে ফল ২০ থেকে ৪০ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণযোগ্য হবে।

নতুন বাজার খুঁজতে কাজ চলছে

চীন ছাড়াও দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যসহ ১০টির বেশি দেশে আমসহ অন্যান্য ফল রপ্তানির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে এবং ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশি আম সেখানে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

কৃষি রপ্তানির সোনালী সম্ভাবনা

চীনে আম রপ্তানি শুধুই একটি শুরুর নাম। এটি বাংলাদেশের কৃষিকে বিশ্ববাজারে তুলে ধরার পথ তৈরি করছে। কৃষকের ঘামে ভেজা সোনালি ফসল যখন বিদেশে পৌঁছায়, তখন শুধু বৈদেশিক মুদ্রাই নয়, দেশের সুনামও বাড়ে। সরকারের পরিকল্পনা, বেসরকারি অংশগ্রহণ এবং আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের কৃষি হবে আরও টেকসই, লাভজনক এবং রপ্তানিমুখী—এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button