ভারতের নিষেধাজ্ঞা দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যে অদৃশ্য এক প্রাচীর

দক্ষিণ এশিয়া—বিশ্বের অন্যতম জনবহুল এবং সম্ভাবনাময় অঞ্চল। অথচ এখানকার দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বাণিজ্যের চিত্র একেবারেই হতাশাজনক। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-পাকিস্তান রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং বাংলাদেশের রপ্তানিপণ্যে ভারতের বিধিনিষেধ নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও সহযোগিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য সম্ভাবনা অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়বে।
দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য: সম্ভাবনার বিপরীতে বাস্তবতা
বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মোট বাণিজ্যের মাত্র ৬ শতাংশ হয় নিজেদের মধ্যে। যেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আন্তঃবাণিজ্য ৬৮ শতাংশ, নাফটা অঞ্চলে তা ৪০ শতাংশের বেশি, আর আসিয়ান অঞ্চলে ২৭ শতাংশ। এর বিপরীতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো পরস্পরের সঙ্গেই ব্যবসা করতে পারে না রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতার কারণে।
দক্ষিণ এশিয়ার মূল আঞ্চলিক বাণিজ্য জোট সার্কের তথ্য মতে, ২০০৩ সালে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল মাত্র ৬০০ কোটি ডলার, যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার কোটি ডলারে। দুই দশকে চারগুণ প্রবৃদ্ধি হলেও অঞ্চলটির সামগ্রিক বাণিজ্য সম্ভাবনার তুলনায় এই অগ্রগতি অত্যন্ত কম।
আস্থাহীনতা, দ্বন্দ্ব আর জটিল কূটনীতি
বিশ্লেষকেরা বলছেন, আঞ্চলিক বাণিজ্য কম হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে পারস্পরিক অবিশ্বাস, আঞ্চলিক নেতৃত্ব নিয়ে প্রতিযোগিতা এবং দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বিরোধ। ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য কাঠামোকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সানেম-এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, “ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য পুরোপুরি বন্ধ, যা সার্কের আঞ্চলিক গতিশীলতাকে স্থবির করে দিচ্ছে। এ অবস্থায় দক্ষিণ এশিয়ার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের সম্ভাবনা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।”
সেলিম রায়হান আরও বলেন, “বাংলাদেশ থেকেও ভারতের কিছু আমদানি পণ্যে বিধিনিষেধ আরোপ হয়েছে, যা আমাদের রপ্তানি প্রবাহে বড় ধাক্কা দিচ্ছে।”
বাংলাদেশ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত?
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ সার্কভুক্ত দেশগুলোতে রপ্তানি করেছে ১৭৪ কোটি ৩৮ লাখ ডলারের পণ্য, যা মোট রপ্তানির মাত্র ৪.৪৭ শতাংশ। বিপরীতে এসব দেশ থেকে আমদানি করেছে ৯৭৬ কোটি ২৫ লাখ ডলারের পণ্য, যা মোট আমদানির ১৫.৪৪ শতাংশ।
অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি অত্যন্ত কম, যদিও আমদানি কিছুটা বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর অন্যতম কারণ হলো শুল্ক ও অশুল্ক প্রতিবন্ধকতা, লজিস্টিক ব্যয়, দুর্বল অবকাঠামো এবং নীতিগত অস্থিরতা।
সার্ক ও অন্যান্য জোট: কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন
সার্কের সর্বশেষ সম্মেলন ২০১৬ সালে হওয়ার কথা থাকলেও তা রাজনৈতিক কারণে স্থগিত হয়ে যায়। এরপর দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক বাণিজ্য এগিয়ে যাওয়ার বদলে পিছিয়ে গেছে। ১৯৯৭ সালে বিমসটেক (BIMSTEC) গঠনের মাধ্যমে নতুন আশার সঞ্চার হলেও, এখন পর্যন্ত এই জোটের আওতায় ২০০৪ সালে স্বাক্ষরিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) বাস্তবায়িত হয়নি।
অর্থাৎ সার্ক, বিমসটেক, সাফটা কিংবা সাপটা—যে জোটই হোক না কেন, কার্যকর বাস্তবায়নের অভাবে সেগুলো দক্ষিণ এশিয়ায় কাঙ্ক্ষিত আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে।
বাণিজ্য চাহিদা থাকলেও বাধা প্রচুর
বিশ্ব ব্যাংকের গবেষণায় বলা হয়েছে, ভারতীয় কোম্পানির জন্য পাকিস্তানি বা বাংলাদেশি কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা করার চেয়ে ব্রাজিলের সঙ্গে ব্যবসা করা ২০ শতাংশ কম ব্যয়বহুল। প্রতিবেশীদের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ, কাস্টমস প্রক্রিয়া জটিল এবং দ্বিপক্ষীয় কূটনীতি দুর্বল হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে আসিয়ান দেশগুলোর মধ্যে যৌথ শুল্কায়ন ও অবাধ পণ্যবাহী যান চলাচল থাকায় তারা নিজেদের মধ্যে শক্তিশালী বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পেরেছে। অথচ দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে এখনো জটিল আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক বিধিনিষেধ বিরাজ করছে।
বিকল্প বাজার ও কৌশল দরকার
বিশ্লেষকেরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সমন্বয় না থাকায় বাংলাদেশকে এখন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। সেলিম রায়হান বলেন, “দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বাজারে রপ্তানি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি দেশীয় উৎপাদনক্ষমতা, গুণগত মান ও অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে।”
সিপিডি’র সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “সাফটার আওতায় বাংলাদেশের পোশাক ভারতে শুল্কমুক্ত প্রবেশ করলেও অশুল্ক বাধায় সেই সুবিধার পুরোটা পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া বর্তমানে এমন পরিবেশও নেই, যেখানে এসব সুবিধা নিয়ে আলোচনা চলতে পারে।”
ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব: আঞ্চলিক শান্তির প্রধান বাধা
বর্তমানে ভারত-পাকিস্তান এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে বিমান চলাচল থেকে শুরু করে ট্রান্সশিপমেন্ট—সব কিছুতেই বিধিনিষেধ। এ পরিস্থিতিতে দক্ষিণ এশিয়ার ভৌগোলিক আন্তঃযোগাযোগ প্রায় অচল। এর প্রভাব শুধু পাকিস্তানেই নয়, বরং সার্ক অঞ্চলের প্রত্যেক দেশেই পড়ছে।
ভারত সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহার করলেও বাংলাদেশ এখনও ভারত হয়ে নেপাল ও ভুটানে পণ্য পাঠাতে পারছে। অর্থাৎ বাণিজ্য একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি, কিন্তু ভারতের ভূরাজনৈতিক অবস্থান এবং নেতৃত্বধারী মনোভাব এই অঞ্চলের পরিণতি নির্ধারণ করছে।
ভবিষ্যৎ কী বলছে?
বিশ্লেষকেরা বলছেন, আঞ্চলিক উত্তেজনা প্রশমনে বৃহত্তর পর্যায়ে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। অর্থনৈতিক কূটনীতিকে জোরদার করতে হবে এবং আঞ্চলিক জটিলতার ভেতর থেকেই বাংলাদেশকে বাস্তবভিত্তিক ও বহুমুখী বাণিজ্য কৌশল গ্রহণ করতে হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার মতো একটি বিশাল বাজার যদি আন্তঃআঞ্চলিক বিভাজনের শিকার হয়, তবে এখানকার জনগণের উন্নয়নও সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। রাজনৈতিক সংকীর্ণতা ও পারস্পরিক অবিশ্বাসের ঊর্ধ্বে উঠে যদি বাণিজ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া যায়, তবে এই অঞ্চলেই গড়ে উঠতে পারে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী অর্থনৈতিক বলয়।