সিঙ্গাপুরে ওয়ালটনের পণ্য বিক্রি শুরু, নতুন পরিবেশক নিয়োগ

বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ইলেকট্রনিকস ও প্রযুক্তিপণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ পিএলসি এবার পণ্য রপ্তানিতে নতুন দিগন্তে প্রবেশ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি ঘোষণা দিয়েছে, সিঙ্গাপুরে তাদের পণ্য বিক্রির জন্য নতুন পরিবেশক নিয়োগ করা হয়েছে এবং এরই মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করতে যাচ্ছে ওয়ালটন।
পাঁচ বছরের পরিবেশক চুক্তি সই
আজ মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তিতে ওয়ালটন জানায়, তারা সিঙ্গাপুরের ফ্লেয়ার এম অ্যান্ড ই পিটিই লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পাঁচ বছরের বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তির আওতায় ফ্লেয়ার এম অ্যান্ড ই সিঙ্গাপুরে ওয়ালটনের একমাত্র পরিবেশক হিসেবে কাজ করবে।
চুক্তির অধীনে সিঙ্গাপুরে বিক্রি হবে ওয়ালটনের জনপ্রিয় পণ্যসমূহ, যার মধ্যে রয়েছে:
- রেফ্রিজারেটর
- শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি)
- টেলিভিশন
- রান্নার সরঞ্জাম
এর মাধ্যমে ওয়ালটনের লক্ষ্য হলো স্থানীয় ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক গ্রাহকদের কাছে ব্র্যান্ডের পরিচিতি বাড়ানো এবং বৈদেশিক আয় বৃদ্ধি করা।
আন্তর্জাতিক সম্প্রসারণে ওয়ালটনের কৌশল
সিঙ্গাপুরে পরিবেশক নিয়োগের ঘটনা ওয়ালটনের বৈশ্বিক সম্প্রসারণ কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এর আগে ওয়ালটনের পণ্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সীমিত পরিসরে পাওয়া গেলেও, এবার তারা একাধিক দেশে কাঠামোগতভাবে রপ্তানিতে জোর দিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সিঙ্গাপুরে ওয়ালটনের উপস্থিতি আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ইলেকট্রনিকস খাতের সক্ষমতা তুলে ধরবে এবং রপ্তানি আয় বাড়াতে সাহায্য করবে।
লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি উৎপাদনের ঘোষণা
ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ সম্প্রতি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কোম্পানির ৪৪তম পরিচালনা পর্ষদ সভায় লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি উৎপাদনের অনুমোদন দেওয়া হয়।
এই ব্যাটারির উৎপাদন শুরু হলে ওয়ালটন:
- বিদ্যুৎচালিত যানবাহন ও ইলেকট্রনিক ডিভাইসের জন্য নিজস্ব ব্যাটারি প্রস্তুত করতে পারবে
- ব্যাটারি খাতে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে নিজস্ব প্রযুক্তির বিকাশ ঘটাতে পারবে
- দেশীয় বাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানির সুযোগ তৈরি করবে
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই পদক্ষেপের ফলে ওয়ালটনের টেকনোলোজি-ভিত্তিক বৈচিত্র্য আরও দৃঢ় হবে, যা ভবিষ্যতের প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
তৃতীয় প্রান্তিকে মুনাফা কমেছে
ওয়ালটনের ব্যবসায়িক সম্প্রসারণের সুখবরের পাশাপাশি, আজকের ডিএসই ঘোষণায় কোম্পানিটির জানুয়ারি-মার্চ ২০২৫ সময়কালের আর্থিক পারফরম্যান্স সম্পর্কেও তথ্য প্রকাশ করা হয়।
জানুয়ারি-মার্চ ২০২৫ প্রান্তিকের প্রতিবেদন:
- শেয়ারপ্রতি আয় (EPS): ১২ টাকা ৯৪ পয়সা
- গত বছর একই সময়: ১৩ টাকা ৯৩ পয়সা
- হ্রাস: প্রায় ৭.১ শতাংশ
অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিক (জুলাই-মার্চ):
- চলতি বছর: ২২ টাকা ৯৯ পয়সা
- গত বছর: ২৫ টাকা ১৭ পয়সা
- মোট হ্রাস: প্রায় ৮.৬৫ শতাংশ
এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, যদিও কোম্পানির আয় এখনো ভালো পর্যায়ে রয়েছে, তবে কিছুটা মুনাফা হ্রাসের চাপ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিরিক্ত খরচ, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক পরিবহন ব্যয় ও মুদ্রার অস্থিরতা এর পেছনে প্রভাব ফেলেছে।
নগদ প্রবাহেও নেতিবাচক চিত্র
অর্থপ্রবাহের দিক দিয়েও ওয়ালটনের সামনে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথম তিন প্রান্তিকে:
- নগদ প্রবাহ (Operating Cash Flow per Share): ঋণাত্মক ১ টাকা ৮৩ পয়সা
- গত বছর: ২২ টাকা ৮৮ পয়সা
নগদ প্রবাহে এমন নেতিবাচক পরিবর্তন কোম্পানির দৈনন্দিন কার্যক্রম চালাতে কিছুটা চাপ তৈরি করতে পারে। বিশ্লেষকদের মতে, পণ্যের মজুত বৃদ্ধি, নতুন বিনিয়োগ এবং বৈদেশিক খাতে সম্প্রসারণে ব্যয় বাড়ার ফলে এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।
বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
ওয়ালটনের সিঙ্গাপুরে প্রবেশ এবং ব্যাটারি উৎপাদনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে কোম্পানির ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে। যদিও স্বল্পমেয়াদে কিছু আয় ও নগদ প্রবাহ হ্রাসের চিত্র দেখা যাচ্ছে, তবে দীর্ঘমেয়াদে নতুন বাজার ও পণ্যের বৈচিত্র্য কোম্পানিটিকে এগিয়ে নিতে পারে।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আনোয়ার হোসেন বলেন:
“ওয়ালটনের মতো প্রতিষ্ঠান যখন নতুন বাজারে প্রবেশ করে, প্রাথমিকভাবে কিছু আর্থিক চাপ থাকাই স্বাভাবিক। তবে তাদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও ব্র্যান্ড ইমেজ ঠিক থাকলে এই বিনিয়োগ থেকেই ভবিষ্যতের বড় মুনাফা আসবে।”
গ্লোবাল ব্র্যান্ড গড়ার পথে ওয়ালটন
ওয়ালটনের সাম্প্রতিক ঘোষণা শুধু তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের বার্তা নয়, বরং এটি বাংলাদেশের প্রযুক্তি ও ইলেকট্রনিকস শিল্পের আন্তর্জাতিকীকরণের দিকেও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সিঙ্গাপুরের মতো প্রতিযোগিতামূলক বাজারে প্রবেশ করার মাধ্যমে তারা প্রমাণ করেছে, দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও বিশ্ববাজারে লড়াই করার সক্ষমতা রাখে।
একইসঙ্গে প্রযুক্তিনির্ভর নতুন উদ্যোগ যেমন লিথিয়াম ব্যাটারি উৎপাদন তাদের টেকসই প্রবৃদ্ধির দিকটি নির্দেশ করে। তবে মুনাফা ও নগদ প্রবাহে যে চাপ রয়েছে, তা সামাল দেওয়ার জন্য কৌশলগত অর্থনীতি পরিচালনাই হবে মূল চ্যালেঞ্জ।