বানিজ্য

সাতক্ষীরার বাগানে ব্যর্থ হাসি: ফলন উদ্দীপনা, দামে হতাশার ছায়া

বাংলাদেশের স্বাদে-রঙে খ্যাত সাতক্ষীরা জেলার বাগানগুলো গত কয়েক সপ্তাহ ধরে পাকা আমে সেজেছে: গোপালভোগ, গোবিন্দভোগ ও হিমসাগরসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন স্বাদের আমের সম্ভার হয়েছে। তবে এই ফলন উৎসবের আনন্দ বিনষ্ট করেছে পাইকারি বাজারে প্রতি মণ (৪০ কেজি) ১৬০০–২২০০ টাকার অস্বস্তিকর মূল্য। পন্য পরিবহনে, শ্রমে, পরিচর্যায় ও বিতরণে কোটি কোটি টাকা খরচ হওয়ার পরেও উৎপাদনকারীরা মূলধন তুলতে পারছেন না। তাতে লাভ তো দূরের কথা, উৎপাদন ব্যয়ও উঠে আসছে না বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বাগানমালিকরা।

১. সাতক্ষীরার আম চাষের বিবর্তন

সাতক্ষীরার মাটি ও আবহাওয়া হাজার বছরের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেছে বাংলাদেশের আম শিল্পে। নদীমাতৃক মাটির উর্বরতা, গ্রীষ্মের পর্যাপ্ত রোদ আর সিমেন্টভর নদী–খালস্রোতে ভাসমান পলি মিশ্রিত জমি মাল্টি ভারাইটি আমের জন্ম দেয়। সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী:

  • ৪১০০ হেক্টর বাগানে বাগানমালিকরা আম চাষ করেন
  • ৫ হাজারের বেশি বাগানফলন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত
  • মোট ৭০ হাজার টন আম উৎপাদন সম্ভাবনা রয়েছে

প্রতি মৌসুমে প্রায় ৫০-৬০ দিন ধরে শরৎের প্রথম হিমসাগর থেকে শুরু করে ল্যাংড়া, আম্রপালি পর্যায়ে বাজারজাত হয়। তবে এ বছর আগাম ফলন শুরু করায় বাগানমালিকদের আশা ছিল—শক্তিশালী পাইকারি চাহিদায় দাম হবে ভালো।

২. পাইকারি বাজারের বর্তমান অবস্থা

গতকাল সকাল থেকেই সাতক্ষীরা সদর উপজেলার সুলতানপুর বড় বাজার আম কেনাবেচায় মুখরিত। এখানে গোপালভোগ, গোবিন্দভোগ প্রতি মণ ১৬০০–২০০০ টাকা, আর হিমসাগর ১৮০০–২২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বড় বড় ট্রাক ভর্তি আম ঢাকাসহ ঢাকার পরিধিতে ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু গণিত এখানে খারাপ:

খাতখরচ (প্রতি মণ)পাইকারি বিক্রয় দামমার্জিন/ক্ষতি
শ্রম ও পরিচর্যা৩০০–৪০০ টাকাপরিশ্রম
পরিবহন১৫০–২৫০ টাকাপরিবহনে ব্যয়
ফড়িয়া কমিশন৫০–১০০ টাকাকমিশন
বাজার দ্বিমুখী খরচ২০০–৩০০ টাকাপ্যাকিং, বন্টন
মোট খরচ৭০০–১০৫০ টাকা
বিক্রয় দাম১৬০০–২২০০ টাকা৫৫০–১৪০০ টাকা লাভ থাকতে পারতো, তবে পাইকারির সাথে শেষ আলোচনায় দাম নেমে আসে ১৩০০–১৫০০ টাকায়, ফলে অনেকেই ক্ষতির মুখে

৩. চাষিদের হতাশার কথা

কুকরালী এলাকার বাগানমালিক লিয়াকত হোসেন বলেন:

“মাটি-শ্রম-সেচ-কলমে খরচ করে যখন প্রতি কেজি ৫৫ টাকা পাই, তা থেকে উৎপাদন খরচও উঠে আসে না।”

বুধহাটা গ্রামের কামরুল ইসলাম যোগ করেন:

“আগের বছর অন্য জেলার আম বাজারে আসার আগে সাতক্ষীরার ব্যাপারীরাও আম কিনে নিয়ে যেত। এ বছর বাইরের চাহিদা নেই, দাম স্লপ!”

তাঁদের অভিযোগ সিন্ডিকেটের নয়; বরং একযোগে আম পাড়ার সময় বাজারে উৎপাদন অতিরিক্ত হওয়ায় চাপ পড়েছে দাম বোঝাতে। সুলতানপুর বাজারের কাঁচামাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক রজব আলী নিশ্চিত করেন:

“সিন্ডিকেট নয়, ভলিউম বেশি—সাপ্লাই অতিিপ্রাক।

৪. মূল কারণ: অতিরিক্ত সাপ্লাই ও মাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন:

  1. একযোগে পাঁঠা ফলন: ৫–১৫ মে গোপালভোগ–গোবিন্দভোগ, ১৫–২০ মে হিমসাগর, পরপর সব জাত পাড়ার ফলে ভলিউম আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে।
  2. স্থানীয় পরিবহন–লজিস্টিক সংকট: রাস্তা-জমার সীমাবদ্ধতা আর ছোট পরিবহনগুলোর অযোগ্যতা ঢাকাসহ দূরবর্তী বাজারে পৌঁছাতে দেরি।
  3. ফড়িয়া নির্ভরতা: ঋণ-এডভান্স নিয়ে পাড়া হওয়ার পর ফড়িয়া কমিশন হার কম হওয়ায় বিক্রেতা বাধ্য হন কম দামে বিক্রি করতে।
  4. স্টোরেজ সুবিধার অভাব: কোল্ড স্টোরেজ না থাকায় তাজা ফল বিক্রি না হলে পচন ধরে, ভুলে যাওয়ার ভয়ে দ্রুত বিক্রয়।

৫. কোল্ড চেইন ও মান নিয়ন্ত্রণ: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

কোল্ড চেইন স্থাপনার মাধ্যমে আম সংরক্ষণ বাড়ানো গেলে দাম ঢিলে–সবর হলে বিক্রয় দীর্ঘায়িত হবে, ফলে চাষিরা বাজারে চাপ সামাল দিতে পারবে। বাংলাদেশ হিমায়িত পণ্য উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ৫টা জেলা কোল্ড স্টোরেজ সুবিধা পেলেও সাতক্ষীরা এখনও পিছিয়ে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মনির হোসেন বলেন:

“চাষিরা যথেষ্ট কঠিন পরিশ্রম করে, কিন্তু বাজার–তত্ত্ব ও স্টোরেজ–লজিস্টিক নিয়ে অবহেলা করছে।”

এছাড়া ফসল বীমা-এর অভাব, ক্রেডিট অনিশ্চয়তা, তাপমাত্রা পরিবহন ব্যত্যয়—সব মিলিয়ে চ্যালেঞ্জ অব্যাহত।

৬. সরকারী হস্তক্ষেপ ও সমাধান

চাষিদের স্বার্থে প্রস্তাবিত কয়েকটি উদ্যোগ:

  1. কারিগরি সহায়তা: দ্রুত ফলন নিরীক্ষণ, ফলের মান রেটিং ও প্রতি ধাপে উৎসাহ
  2. কোল্ড স্টোরেজ বরাদ্দ: সরকারি বরাদ্দ বাড়িয়ে ১০–২০ হেক্টরে সংরক্ষণ সুবিধা
  3. বীমা প্যাকেজ: ফসল বীমা ও পরিবহন বীমা চালু করে ঝুঁকি হ্রাস
  4. পরিবহন উন্নয়ন: সরাসরি ঢাকাসহ প্রধান শহরে দ্রুত লজিস্টিক ব্যবস্থা
  5. এসোসিয়েশন শক্তিশালীকরণ: সাতক্ষীরা আম ব্যবসায়ী সমিতি ও কৃষক গ্রুপের সংগঠন, মার্কেটিং প্রশিক্ষণ

সরকারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জিআইএস বিভাগ এরই মধ্যে কয়েকটি pilot প্রকল্প চালু করেছে। আন্তঃশিল্প সমন্বয় সেল থেকে জানানো হয়, দ্রুততম সময়ে ১৫০০০ মেট্রিক টন কোল্ড চেইন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

৭. ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা: মান-উন্নয়ন ও রপ্তানি

বাংলাদেশের আমের রপ্তানির সম্ভাবনা আন্তর্জাতিক বাজারে উজ্জ্বল। বিনা ঘটিকায় আমের মাংসময়, শক্তিশালী প্যাকেজিং ও মান নিয়ন্ত্রণে বিনিয়োগ বাড়িয়ে অতিরিক্ত মূল্য অর্জন সম্ভব। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক আম রপ্তানি ২০১৯ সালে ছিল ৫৫ কোটি ডলার, যা ২০২৫-২৬ তে ৮০ কোটি ছোঁয়ার লক্ষ্য।

আম রপ্তানির জন্য:

  • جی آئی (Geographical Indication) ক্লাসিকেশন
  • এগ্রো-প্রসেসিং জোন প্রতিষ্ঠা
  • বিনা-পোকা পরিবহনএয়ার কার্গো সুবিধা

৮. চাষিদের প্রত্যাশা

সাতক্ষীরা আম চাষিরা আশা করছেন:

  • দাম রক্ষাকারী ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (MSP): প্রতি মণ কমপক্ষে ২০০০ টাকা
  • অ্যাডভান্স ক্রেডিট: ফড়িয়া–বিনা শর্তে এডভান্স
  • বাজার তথ্য ব্যবস্থা: মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে প্রতিবর্ত ভবিষ্যদ্বাণী
  • সংগঠিত মার্কেটিং: সমবায় গ্রুপে যোগ দিয়ে সরাসরি বৃহৎ হোলসেলারদের সাথে চুক্তি

সাতক্ষীরার বাগানে আগাম ফলনের উদ্দীপনা যতই হোক, বীজ-বৃদ্ধি ও পরিচর্যায় ব্যয়িত পরিশ্রম বিনিময়ে দর ন্যূনতম পর্যায়েও না পাওয়ায় চাষিরা দিশাহীন। সরকারী সহায়তা, কোল্ড চেইন বিনিয়োগ ও মার্কেটিং সম্প্রসারণ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক থাকা দূরলভ। স্থানীয় কৃষকদের আশা, সুষ্ঠু নীতি ও প্রযুক্তিগত সহায়তা পেলে সাতক্ষীরার স্বাদে-গন্ধে ভরা আম আবারো খাদ্যপ্রেমীদের তালিকায় স্থান করে দেবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button