বানিজ্য

শেয়ারবাজারে দরপতনের প্রতিবাদে বিনিয়োগকারীদের কফিন মিছিল

দেশের শেয়ারবাজারে টানা দরপতনের প্রতিবাদে আজ রাজধানী ঢাকায় অনন্য এক বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন ক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা। তাঁরা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের অপসারণের দাবিতে রাস্তায় নামেন এবং প্রতীকী কফিন মিছিল ও গায়েবানা জানাজা কর্মসূচি পালন করেন। বিনিয়োগকারীদের দাবি, বিএসইসি কর্তৃপক্ষ শেয়ারবাজারে দরপতন রোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হওয়ায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

কফিন মিছিল ও প্রতীকী জানাজা

আজ রোববার দুপুর আড়াইটার দিকে রাজধানীর মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান ফটকের সামনে প্রথমে বিক্ষোভ শুরু হয়। পরে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে বিনিয়োগকারীরা একটি কফিন বহন করে শোক মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শুরু হয়ে ইত্তেফাক মোড় ঘুরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ভবনের সামনে গিয়ে শেষ হয়।

বিক্ষোভকারীরা “পুঁজিবাজার ধ্বংসের বিচার চাই”, “চেয়ারম্যান হটাও, বাজার বাঁচাও” ইত্যাদি স্লোগানে পুরো এলাকা মুখরিত করেন। তাঁদের দাবি, বর্তমান বিএসইসি নেতৃত্বে শেয়ারবাজার পরিকল্পিতভাবে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে এবং এর পেছনে রয়েছে প্রশাসনিক উদাসীনতা ও স্বচ্ছতার অভাব।

মিছিল শেষে বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে ডিএসই ভবনের সামনে ‘পুঁজিবাজারের কফিন’ নামাঙ্কিত একটি প্রতীকী কফিন সামনে রেখে গায়েবানা জানাজা আদায় করেন বিনিয়োগকারীরা। তাঁরা বলেন, এই জানাজা মূলত দেশের পুঁজিবাজারের জন্য, যা সরকারের অব্যবস্থাপনার কারণে মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছে।

বিনিয়োগকারীদের ক্ষোভ ও বক্তব্য

বিক্ষোভে উপস্থিত বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইকবাল হোসেন বলেন, “পুঁজিবাজার আজ বন্দী হয়ে পড়েছে এক নব্য স্বৈরাচারের আয়নাঘরে। সাধারণ বিনিয়োগকারী প্রতিনিয়ত ক্ষতির শিকার হচ্ছেন, অথচ নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিশ্চুপ।”

তিনি আরও বলেন, “যদি এই সরকার পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়, তবে তাদের উচিত দ্রুত অন্তর্বর্তী নির্বাচন দিয়ে দায়িত্বশীল নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।” তাঁর দাবি, এভাবে বাজারকে অস্থিতিশীল রেখে আর অর্থনীতির উন্নয়ন সম্ভব নয়।

ইকবাল হোসেন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, “আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে যদি বিএসইসি চেয়ারম্যানকে অপসারণ না করা হয়, তবে দেশের প্রায় ৩৩ লাখ ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারী প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে গণসমাবেশ করবেন। প্রয়োজনে লাগাতার কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হবে।”

অবরোধ ও যান চলাচলে বিঘ্ন

মিছিল ও বিক্ষোভ চলাকালে ডিএসই ভবনের সামনে বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় বসে পড়ে অবরোধ শুরু করেন। এতে করে ঐ এলাকায় প্রায় ২০ মিনিট যান চলাচল বন্ধ থাকে। কর্মজীবী মানুষ, অফিসযাত্রী এবং সাধারণ পথচারীদের দুর্ভোগের মুখে পড়তে হয়। তবে বিনিয়োগকারীদের দাবি, সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এটি ছিল একটি অনিবার্য পদক্ষেপ।

শেয়ারবাজারে টানা দরপতন

গত কয়েক মাস ধরেই দেশের শেয়ারবাজারে একটানা দরপতন চলছে। বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারদর প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এমনকি মৌলভিত্তিসম্পন্ন অনেক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারও পতনের মুখে। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে ত্বরিত ও বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত দরকার। কিন্তু বিএসইসির তরফে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না আসায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাজারে তারল্য সংকট, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের নিষ্ক্রিয়তা এবং মন্দা অর্থনৈতিক সূচক—সব মিলিয়ে এক ধরনের নেতিবাচক আবহ তৈরি হয়েছে। এর মধ্যেই যখন সাধারণ বিনিয়োগকারী তাদের পুঁজি হারিয়ে হতাশ, তখন নিয়ন্ত্রক সংস্থার নীরবতা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে।

সরকারের প্রতি আহ্বান

বিক্ষোভকারীরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, পুঁজিবাজারের এই সংকট নিরসনে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক। তাঁদের দাবির মধ্যে রয়েছে:

  1. বিএসইসি চেয়ারম্যান ও সংশ্লিষ্ট কমিশনারদের পদত্যাগ বা অপসারণ
  2. পুঁজিবাজারে তারল্য সরবরাহ নিশ্চিত করা
  3. প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা
  4. শেয়ারবাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা
  5. ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের পুনর্বাসনের জন্য বিশেষ তহবিল গঠন

তাঁরা বলেন, এই দাবিগুলো বাস্তবায়ন না হলে বিনিয়োগকারীরা রাজপথে আরও বড় পরিসরে আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবেন।

ভবিষ্যৎ কর্মসূচি

বিক্ষোভ শেষে আয়োজক সংগঠনগুলো ঘোষণা দেয়, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দাবি আদায় না হলে পরবর্তী ধাপে তারা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন। পাশাপাশি জেলা পর্যায়েও আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়া হবে। বিনিয়োগকারীদের এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে শেয়ারবাজারে একটি নতুন মোড় বলে উল্লেখ করেছেন অনেকে।

উপসংহার

বাংলাদেশের পুঁজিবাজার দীর্ঘদিন ধরে সংকটে থাকলেও তা সমাধানে কাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা। তাঁদের মতে, সরকারের সদিচ্ছা থাকলে পুঁজিবাজার আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারে। তবে তার জন্য প্রয়োজন জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও দূরদর্শী নেতৃত্ব। আজকের কফিন মিছিল শুধু প্রতীকী প্রতিবাদ নয়, এটি একটি আর্তনাদ—যা সরকারের কর্ণগোচর হলে হয়তো সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আবারও নতুন করে আশা করতে পারেন।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button