পাসপোর্টে ডলার এনডোর্সমেন্ট সর্বোচ্চ ফি ৩০০ টাকা

বৈধ পথে বৈদেশিক মুদ্রা কিনতে গিয়ে গ্রাহকদের নানা ধরনের অতিরিক্ত চার্জ বা ফি গুনতে হচ্ছে—এমন অভিযোগ দীর্ঘ দিন ধরেই আসছিল। ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে এই ধরনের অযাচিত চার্জ আদায়ের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রাহকদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ তৈরি হচ্ছিল। বিষয়টি নজরে আসার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, পাসপোর্টে বৈদেশিক মুদ্রা এনডোর্সমেন্টের জন্য ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা ফি নিতে পারবে। এর বাইরে কোনোভাবেই ‘সার্ভিস ফি’, ‘কমিশন’ বা অন্য কোনো নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা যাবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নির্দেশনা অবিলম্বে কার্যকর হয়েছে।
শনিবার (১৭ মে) বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা নীতি বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি সার্কুলার জারি করা হয়। সার্কুলারে তফসিলি ব্যাংকগুলোর উদ্দেশে এই নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে অভিযোগ আসছিল যে, কিছু ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা এনডোর্সমেন্টের ক্ষেত্রে নির্ধারিত ফির চেয়ে বেশি অর্থ আদায় করছে। শুধু তাই নয়, তারা এনডোর্সমেন্ট ফির সঙ্গে যোগ করে বিভিন্ন নামে অতিরিক্ত চার্জ বা কমিশনও নিচ্ছে, যা সম্পূর্ণ অনৈতিক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধিবিধানের পরিপন্থী। এই ধরনের কর্মকাণ্ড সাধারণ গ্রাহকদের বৈধ উপায়ে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহে নিরুৎসাহিত করছিল এবং তাদের মধ্যে এক প্রকার ভোগান্তি সৃষ্টি করছিল।
বৈদেশিক মুদ্রা নীতি বিভাগের ওই সার্কুলারে আরও বলা হয়েছে যে, তফসিলি ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে এই ধরনের অতিরিক্ত ফি আদায়ের প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। ব্যাংকগুলো একদিকে যেমন পাসপোর্টে বৈদেশিক মুদ্রার এনডোর্সমেন্ট করার জন্য নির্ধারিত ৩০০ টাকার বেশি চার্জ নিচ্ছে, তেমনি এর সঙ্গে যুক্ত করছে তথাকথিত ‘সার্ভিস ফি’ বা ‘কমিশন’। এতে করে সাধারণ গ্রাহকদের ওপর আর্থিক চাপ বাড়ছিল। দেশের বাইরে ভ্রমণ বা অন্য কোনো বৈধ প্রয়োজনে যাদের বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হয়, তারা ব্যাংকের এই অতিরিক্ত চার্জের কারণে নিরুৎসাহিত হয়ে বিকল্প পন্থায় মুদ্রা সংগ্রহ করতে বাধ্য হতে পারেন বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশঙ্কা করছে। এই পরিস্থিতি বৈধ চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং অবৈধ মুদ্রা কেনা-বেচার প্রবণতা বাড়াতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং গ্রাহকবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। ব্যাংকগুলো যদি অযাচিত চার্জ আদায় করে, তবে গ্রাহকদের আস্থা নষ্ট হয় এবং তারা বৈধ চ্যানেলের পরিবর্তে অন্য কোনো পথ বেছে নিতে আগ্রহী হন। এটি সামগ্রিকভাবে দেশের আর্থিক শৃঙ্খলার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষা এবং বৈধ পথে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকে উৎসাহিত করার জন্য এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
সার্কুলারে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ৪৫ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এই নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। আইনের এই ধারা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে এবং গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারির ক্ষমতা প্রদান করে। এই নির্দেশনা অবিলম্বে কার্যকর হওয়ায় এখন থেকে কোনো ব্যাংক পাসপোর্টে ডলার বা অন্য কোনো বৈদেশিক মুদ্রা এনডোর্সমেন্টের জন্য ৩০০ টাকার বেশি ফি নিতে পারবে না। পাশাপাশি এনডোর্সমেন্ট প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত অন্য কোনো প্রকার সার্ভিস ফি বা কমিশন আদায়ের সুযোগ থাকছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে, এই নির্দেশনার ফলে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ প্রক্রিয়া আরও সহজ ও স্বচ্ছ হবে। গ্রাহকরা কোনো প্রকার অতিরিক্ত চার্জের চিন্তা ছাড়াই ব্যাংক থেকে তাদের প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করতে পারবেন। এটি একদিকে যেমন গ্রাহকদের ভোগান্তি কমাবে, তেমনি অন্যদিকে বৈধ পথে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে। অবৈধ চ্যানেলে মুদ্রা কেনাবেচার প্রবণতা হ্রাস পাবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হবে।
ব্যাংকগুলোর জন্য এই নির্দেশনা বাধ্যতামূলক এবং এর ব্যত্যয় ঘটলে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়মিতভাবে ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম তদারকি করে থাকে এবং এই নির্দেশনার যথাযথ পরিপালন নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। ব্যাংকগুলোকে তাদের সকল শাখায় এই নির্দেশনা সম্পর্কে অবহিত করার এবং গ্রাহকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত চার্জ আদায় থেকে বিরত থাকার জন্য সতর্ক করা হয়েছে।
সাধারণ গ্রাহকদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানানো হয়েছে। অনেক গ্রাহক অভিযোগ করেছিলেন যে, বৈদেশিক মুদ্রা এনডোর্সমেন্টের সময় বিভিন্ন ব্যাংক বিভিন্ন হারে ফি আদায় করত, যা অনেক সময় ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্তও হতো। এর সঙ্গে যুক্ত হতো নানা ধরনের লুকানো চার্জ। এখন একটি নির্দিষ্ট এবং সীমিত ফি নির্ধারণ করে দেওয়ায় তাদের ভোগান্তি অনেকটাই কমবে বলে তারা মনে করছেন। এটি গ্রাহকদের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ প্রক্রিয়াকে আরও অনুমানযোগ্য এবং সাশ্রয়ী করবে।
বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ প্রক্রিয়া দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বৈধ চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ বৃদ্ধি পেলে তা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করে এবং মুদ্রা বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে অবদান রাখে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নির্দেশনা সেই লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নির্দেশনা গ্রাহকদের অধিকার সুরক্ষার পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক আর্থিক ব্যবস্থাপনার শৃঙ্খলা রক্ষায় একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ। ব্যাংকগুলোর উচিত এই নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ করে গ্রাহকদের জন্য একটি সহজ ও স্বচ্ছ বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন পরিবেশ তৈরি করা। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন গ্রাহকদের আস্থা বৃদ্ধি পাবে, তেমনি দেশের অর্থনীতির সুস্থ বিকাশও ত্বরান্বিত হবে। এই নির্দেশনার কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করার দায়িত্ব এখন ব্যাংকগুলোর ওপর বর্তায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই বিষয়ে তাদের নজরদারি অব্যাহত রাখবে।