ব্যাংক ঋণ পরিশোধে ভোজ্যতেল কোম্পানি বিক্রি করবে গ্লোব গ্রুপ

দীর্ঘদিনের ব্যাংক ঋণ পরিশোধ এবং লোকসানে থাকা ভোজ্যতেল ব্যবসাকে পুনর্গঠিত করার লক্ষ্যে, দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালস গ্রুপ অব কোম্পানিজ তাদের ভোজ্যতেল ইউনিট, গ্লোব এডিবল অয়েল লিমিটেড, বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই পদক্ষেপটি দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, বিশেষত যখন দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের বোঝা ক্রমবর্ধমান। এই সম্ভাব্য বিক্রির মাধ্যমে গ্লোব গ্রুপ তাদের বিশাল আর্থিক দায়ভার সমন্বয়ের চেষ্টা করছে, যার একটি বড় অংশ ইসলামী ব্যাংকের কাছে বকেয়া রয়েছে।
খাত সংশ্লিষ্টদের ধারণা, শিল্পগোষ্ঠী আবুল খায়ের গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকায় গ্লোব এডিবল অয়েল লিমিটেড অধিগ্রহণ করতে পারেন। এই অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া যদি চূড়ান্ত হয়, তবে এটি দেশের ভোজ্যতেল শিল্পে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনবে। তবে, এই বিষয়ে গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালস গ্রুপ অব কোম্পানিজের পরিচালক সামির আল রশিদ জানিয়েছেন যে, অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া এখনও চূড়ান্ত হয়নি এবং তিনি কোম্পানি বিক্রির কোনো আর্থিক বিবরণ প্রকাশ করতে চাননি। তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছেন, “এটি কেবল ব্যাংকের দায় সমন্বয় করতে করা হচ্ছে। আমরা ব্যাংকগুলোর সুদ পরিশোধ করতে না পারায় বেশিরভাগ দায় জমেছে।” এই মন্তব্য ইঙ্গিত করে যে, গ্লোব গ্রুপ তাদের আর্থিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য একটি জরুরি পদক্ষেপ নিচ্ছে।
গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালস গ্রুপ অব কোম্পানিজের চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ এই পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য সরাসরি এস আলম গ্রুপকে দায়ী করেছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন যে, গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গ্লোব এডিবল অয়েল লিমিটেডের ওপর এস আলম গ্রুপের প্রভাব শেষ হয়। হারুনুর রশীদ এই পরিস্থিতিকে ‘শত্রুতামূলক অধিগ্রহণ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং অভিযোগ করেছেন যে, ইসলামী ব্যাংকের প্রভাব খাটিয়ে এস আলম গ্রুপ গ্লোবের ভোজ্যতেল ব্যবসা বিক্রি করতে বাধ্য করেছে। তার মতে, এস আলম গ্রুপের অবৈধ হস্তক্ষেপের কারণে গ্লোব এডিবল অয়েল লিমিটেড গত ১৫ বছর ধরে সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে, যার ফলে প্রতিষ্ঠানটির দায়ভার দিন দিন বেড়েছে। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ইসলামী ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এস আলম গ্রুপের অবৈধ হস্তক্ষেপের কারণে তারা ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি লোকসান করেছেন। এই গুরুতর অভিযোগ দেশের ব্যাংক ব্যবস্থার গভীরে প্রভাব বিস্তারকারী কর্পোরেট ক্ষমতা এবং রাজনৈতিক যোগসাজশের একটি জটিল চিত্র তুলে ধরে।
গ্লোব এডিবল অয়েল লিমিটেডের উপর ইসলামী ব্যাংকের গুলশান শাখার (সার্কেল ০১) প্রায় এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা দায় রয়েছে। এই শাখা থেকে বিতরণকৃত প্রায় তিন হাজার ১০০ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে প্রায় দুই হাজার ৭৫০ কোটি টাকা বর্তমানে মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে, যার মধ্যে গ্লোব এডিবল অয়েল লিমিটেড এই শাখার সবচেয়ে বড় ঋণগ্রহীতা। ব্যাংকের কর্মকর্তারা এই অধিগ্রহণ পরিকল্পনা নিয়ে কিছু তথ্য প্রকাশ করেছেন, যার মধ্যে প্রাথমিকভাবে ৩০০ কোটি টাকা পরিশোধ এবং অবশিষ্ট দায় পুনঃতফসিল করা ও সুদের একটি অংশ মওকুফ করার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। এই প্রস্তাবনা যদি কার্যকর হয়, তবে এটি ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের বোঝা কমাতে সাহায্য করবে এবং গ্লোব গ্রুপের জন্য কিছুটা স্বস্তি বয়ে আনবে।
এ বিষয়ে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. ওমর ফারুক খান বলেন, গ্লোব এডিবল অয়েল লিমিটেড তাদের ঋণ পরিশোধের জন্য কোম্পানিটি বিক্রি করে দেবে বলে জানিয়েছিল। তিনি যোগ করেন, “আবুল খায়ের গ্রুপ কোম্পানিটি কিনে নেবে বলে আমরা শুনেছি, তবে এখনো কোনো পক্ষই আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের কিছু জানায়নি।” অন্যদিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আবুল খায়ের গ্রুপের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, এই উদ্যোগটি আবুল খায়ের গ্রুপের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, এটি তাদের চেয়ারম্যান আবুল কাশেমের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা। তবে, এ বিষয়ে আবুল কাশেমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
গ্লোব গ্রুপ ২০১১ সালে স্বাস্থ্য সচেতন মধ্যম আয়ের জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণে সূর্যমুখী তেলের মাধ্যমে ভোজ্যতেল বাজারে প্রবেশ করেছিল। কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণ ও ভোজ্যতেল কোম্পানি স্থাপনে ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের জন্য তারা ২০১১ সালে ইসলামী ব্যাংকে আবেদন করে। প্রথম দফায় ব্যাংকটি কোম্পানিটিকে ২৮২ কোটি টাকা ঋণ দেয়। তবে, কারখানা নির্মাণের সময় ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তন হওয়ায় টাকা আটকে যায়। এই আকস্মিক পরিবর্তন গ্লোব এডিবল অয়েল লিমিটেডের কার্যক্রমে বড় ধরনের বাধার সৃষ্টি করে এবং প্রতিষ্ঠানটিকে লোকসানে পড়তে হয়। হারুনুর রশীদ উল্লেখ করেন, এটিই ছিল তাদের সংকটের শুরু, যা পরবর্তীকালে এস আলম গ্রুপের কথিত হস্তক্ষেপের কারণে আরও গভীর হয়।
এই পুরো পরিস্থিতি বাংলাদেশের কর্পোরেট ঋণ সংস্কৃতি, ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা এবং রাজনৈতিক প্রভাবের একটি বড় চিত্র তুলে ধরে। একটি সফল ভোজ্যতেল কোম্পানি কীভাবে বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক চাপের কারণে সংকটের মুখে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত বিক্রি হতে বাধ্য হয়, তা এই ঘটনা থেকে স্পষ্ট। যদি আবুল খায়ের গ্রুপের চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়, তবে এটি একদিকে যেমন গ্লোব গ্রুপের বিশাল আর্থিক দায়ভারের সমাধান দেবে, তেমনি অন্যদিকে দেশের অন্যতম বড় শিল্প গ্রুপের ভোজ্যতেল খাতে প্রবেশ বাজার dynamics-এ নতুন মাত্রা যোগ করবে। এটি অন্যান্য ব্যাংক ও শিল্পগোষ্ঠীগুলোর জন্য একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করতে পারে, যেখানে দীর্ঘমেয়াদী খেলাপি ঋণ এবং অব্যবস্থাপনার কারণে ক্ষতির শিকার হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে কীভাবে পুনর্গঠিত করা যায়।