বানিজ্য

হ্যালো টাস্কের বছরে আয় এক কোটি টাকা

বাংলাদেশের গৃহস্থালি খাতে সেবার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে ‘হ্যালো টাস্ক’। গৃহকর্মী সরবরাহকে আধুনিক অ্যাপ-ভিত্তিক সেবায় রূপান্তর করে এই স্টার্টআপ বর্তমানে বছরে এক কোটি টাকা আয়ের ঘরে পৌঁছে গেছে। সময়োপযোগী আইডিয়া, সঠিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও নারীকেন্দ্রিক সেবা চালুর কারণে প্রতিষ্ঠানটি আজ ঢাকার কয়েক হাজার বাসায় নির্ভরযোগ্য একটি নাম।

সাততলা ভবন থেকে নামার চিন্তা থেকে শুরু

হ্যালো টাস্কের যাত্রা শুরু হয় ২০১৭ সালে, দুই ভাই মাহমুদুল হাসান ও মেহেদি স্মরণের উদ্যোগে। নাম ছিল ‘রোবট ডাকো’। উদ্দেশ্য ছিল ঘর থেকে বের না হয়ে বাসার কেনাকাটা বা কাজের জন্য কাউকে ভাড়া করা। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারের পর অনেকেই এটিকে গৃহকর্মী সরবরাহকারী সেবা ভাবেন। তখনই তারা বুঝে যান—মানুষের এই সেবার চাহিদা রয়েছে। সেখান থেকেই নাম পরিবর্তন করে ২০১৮ সালে যাত্রা শুরু হয় ‘হ্যালো টাস্ক’-এর।

ব্যবসার পেছনের মানবিক ভাবনা

মোহাম্মদপুরে বসবাসকালীন সময়ে মেহেদি স্মরণ দেখতেন, পোশাক কারখানার সামনে চাকরি খুঁজতে নারী শ্রমিকদের ভিড়। কিন্তু চাকরি মিলত না সবার। তখন মাথায় আসে—এই নারীদের গৃহকর্মী হিসেবে প্রশিক্ষিত করে ঘরে ঘরে সেবা দিতে পারলে একদিকে চাকরির সুযোগ তৈরি হবে, অন্যদিকে বাড়বে সেবার মান।

এই চিন্তাভাবনা থেকেই প্রতিষ্ঠানটি শুরুতে ১০ জন নারী গৃহকর্মীকে মাসিক ১৫ হাজার টাকা বেতনে নিয়োগ দেয়। কর্মীদের বাড়িতে পৌঁছে দিতে কেনা হয় পুরোনো দুটি মোটরসাইকেল। শুরুর দিকেই প্রতিদিন ৭০০-৮০০ আবেদন আসতে থাকে। কর্মী সংকট মোকাবেলায় তারা যুক্ত হয় ‘সুনীতি প্রজেক্ট’-এর সঙ্গে, যেখানে ১৬ হাজার নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা হয়।

বিনিয়োগ ও আয়

২০১৮ সালে স্টার্টআপটি মার্কেন্টাইল ব্যাংকের উদয়ন প্রকল্প থেকে ৪০ লাখ টাকার ঋণ পায়। সময়ের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি তিন কোটির বেশি বিনিয়োগও সংগ্রহ করে। তবে ২০২২ সালের পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি বিনিয়োগের ওপর কম নির্ভর করে মুনাফাভিত্তিক ব্যবসায় মনোযোগ দেয়।

বর্তমানে হ্যালো টাস্কের বছরে আয় ১ কোটি টাকার বেশি। প্রতিষ্ঠানের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মেহেদি স্মরণ বলেন, “আমরা এখনো লাভজনক না হলেও চলতি বছরের জুলাইয়ের মধ্যে ব্রেক ইভেন অর্জনের আশা করছি।”

প্রযুক্তিনির্ভর সেবা: IVR ও নিরাপত্তা

হ্যালো টাস্ক গৃহকর্মী সরবরাহের জন্য ব্যবহার করে IVR (ইন্টারঅ্যাকটিভ ভয়েস রেসপন্স) প্রযুক্তি। গ্রাহক অ্যাপে কাজের জন্য আবেদন করলে গৃহকর্মীর ফোনে সরাসরি কল যায়। তারা ১ চাপলে কাজের তথ্য চলে আসে মেসেজে। এই প্রক্রিয়া সেবা দ্রুততা ও দক্ষতা বাড়িয়েছে।

গৃহকর্মীদের নিরাপত্তায় যুক্ত করা হয়েছে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯, যাতে প্রয়োজন হলে তাৎক্ষণিক সহায়তা নেওয়া যায়।

অ্যাপ-ভিত্তিক আধুনিক সেবা

হ্যালো টাস্ক মোবাইল অ্যাপ থেকে ঘণ্টা ও মাসিক ভিত্তিতে গৃহকর্মী ভাড়া নেওয়া যায়। বর্তমানে তাদের নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা ১ লাখ ৩০ হাজারের বেশি। প্রতিষ্ঠানটি রাজধানীর প্রায় ১ হাজার পাড়া-মহল্লায় সেবা দেয়, মাসিক গড়ে ৩ হাজারেরও বেশি সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করে।

ঢাকার বসুন্ধরা, গুলশান, বনানী ও ধানমন্ডি এলাকায় এদের গ্রাহক সবচেয়ে বেশি। বসুন্ধরা এলাকা থেকেই আসে মোট গ্রাহকের ৩০ শতাংশ।

সেবার মূল্য ও কার্যক্রম

বর্তমানে হ্যালো টাস্কের নিবন্ধিত গৃহকর্মীর সংখ্যা প্রায় ৪৫০ জন। সেবার মূল্য:

  • ঘণ্টাপ্রতি (৩ ঘণ্টা): ৬৯০ টাকা
  • মাসিক (৩ ঘণ্টা দৈনিক): ৭,৮০০ টাকা

একজন গৃহকর্মী দিনে ৮ ঘণ্টা কাজ করে মাসে গড়ে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন। গ্রাহকেরা চাইলে ১০ টাকা দিয়ে আবেদন করে সেবা নিতে পারেন। পছন্দ না হলে দ্রুত কর্মী পরিবর্তনের সুবিধাও রয়েছে।

মহামারি ও টেকসইতা

করোনা মহামারিতে সেবায় ধাক্কা এলেও হ্যালো টাস্ক থেমে যায়নি। তারা অ্যাপ উন্নয়ন, সেবা মানোন্নয়ন ও কর্মীবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারে মনোযোগ দেয়। এতে তাদের খরচ কমে, কার্যক্ষমতা বাড়ে।

সামাজিক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

হ্যালো টাস্ক শুধু প্রযুক্তিনির্ভর সেবা নয়, এটি একটি সামাজিক উদ্যোগও। নিম্নআয়ের নারীশ্রমিকদের জন্য এটি আয়ের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি শহরজীবনের গৃহস্থালি সমস্যা দূর করার নির্ভরযোগ্য সমাধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটি ভবিষ্যতে ঢাকা ছাড়িয়ে দেশের অন্যান্য শহরে সেবা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button