ছয় নারী উদ্যোক্তা পেলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্মাননা

রাজধানীর বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে বাংলাদেশ ব্যাংক আয়োজিত চার দিনব্যাপী ‘এসএমই নারী উদ্যোক্তা মেলা’র সমাপনী দিনে ছয়জন নারী উদ্যোক্তাকে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। রোববার বিকেলে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে সম্মাননা ক্রেস্ট ও আর্থিক পুরস্কার তুলে দেওয়া হয় তাঁদের হাতে। এই মেলার মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ও স্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রচেষ্টাকে তুলে ধরা হয়েছে।
সম্মানিত নারী উদ্যোক্তারা: সাফল্যের গল্প
এবারের মেলায় ৩৯ জন ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী উদ্যোক্তার মধ্য থেকে ছয়জনকে তাঁদের ব্যতিক্রমী অবদানের জন্য পুরস্কৃত করা হয়। এঁদের মধ্যে রাঙামাটির ছেনছেন রাখাইন অন্যতম। ২৫ বছর আগে মাত্র ৫ হাজার টাকার মূলধন নিয়ে তিনি ‘মেসার্স মে রাখাইন বার্মিজ স্টোর’ প্রতিষ্ঠা করেন। পাহাড়ি নারীদের জন্য তাঁতের তৈরি পোশাক উৎপাদনের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই প্রতিষ্ঠান বর্তমানে পিনন, খাদি, ব্লাউজ, খামি উৎপাদন ও বিপণন করে সফলতার শিখরে পৌঁছেছে। ছেনছেন রাখাইনের এই উদ্যোগ শুধু ব্যবসায়িক সাফল্যই নয়, স্থানীয় নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি করেছে।
বাগেরহাটের রোজি আহমেদের প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স অর্গানিক প্রোডাক্ট’ আরেকটি উল্লেখযোগ্য নাম। নারিকেলের খোসা থেকে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক তন্তু (কোকো ফাইবার), কাপড় ও তুলা দিয়ে তৈরি করা ১৩ ধরনের পাখির বাসা, বিড়ালের ঘর, সফট টয় ও পেট টয়সহ নানা পণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন জার্মানি, গ্রিস ও বেলজিয়ামে রপ্তানি হচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠান পরিবেশবান্ধব পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি করছে।
ফরিদপুরের সাবেকুন নাহারের ‘লাম ক্রিয়েশন’ পাট, সুতা, ছন ও কচুরিপানা দিয়ে মাদুর, ঝুড়ি ও ব্যাগ তৈরি করে স্থানীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করেছে। তাঁর এই উদ্যোগ শুধু ব্যবসায়িক নয়, পরিবেশ সংরক্ষণ ও স্থানীয় কারিগরদের জন্য আয়ের পথও তৈরি করেছে।
সিলেটের রোজিনা আলিমের ‘মেসার্স মিনার কেমিক্যাল অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্টস’ মোমবাতি, নারিকেল তেল, শর্ষের তেল, আগরবাতি, বোরিক পাউডার, মশার কয়েল, গ্লিসারিন ও ভ্যাসলিনসহ বিভিন্ন রাসায়নিক পণ্য উৎপাদন করে। এই প্রতিষ্ঠানটি স্থানীয় বাজারের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
ঢাকার সাভারের আয়েশা বেগমের ‘মুসলিম জুয়েলারি ওয়ার্কশপ’ রুপা, তামা ও পিতলের তৈরি অলংকারের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে বাংলাদেশের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠান বিদেশি মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি স্থানীয় কারিগরদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে।
পাবনার ঈশ্বরদীর হোসনে আরার ‘আকলিমা সেবা ক্লিনিক ও নার্সিং হোম’ নারীদের স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ২০০৪ সালে স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুর পর গৃহিণী থেকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে তিনি এই প্রতিষ্ঠানকে সফলতার শিখরে নিয়ে গেছেন। ২০১২ সালে এশিয়া স্বপ্নপুরী ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে কবি সুফিয়া কামাল স্বর্ণপদক পাওয়া এই প্রতিষ্ঠান সামাজিক সেবায়ও অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
মেলার তাৎপর্য ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা
সমাপনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নূরুন নাহার বলেন, “দেশের উন্নয়নে নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা অত্যন্ত জরুরি। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য একটি নিয়মিত মঞ্চ তৈরি করতে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিবছর এ ধরনের মেলা আয়োজনের পরিকল্পনা করছে।” তিনি আরও জানান, এই মেলা নারীদের ব্যবসায়িক দূরদর্শিতা, দায়িত্বশীলতা ও স্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টির মানসিকতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই অ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রামস বিভাগের পরিচালক নওশাদ মোস্তফা জানান, চার দিনের এই মেলায় প্রায় ৬০ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হয়েছে। এই অর্থ নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন, “নারী উদ্যোক্তারা শুধু নিজেদের জন্য নয়, সমাজের জন্যও সম্পদ। তাঁদের এই প্রচেষ্টা দেশের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করবে।”
মেলার প্রভাব ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
এই মেলায় ৭৩ জন নারী উদ্যোক্তা অংশ নেন, যাঁদের প্রত্যেককে অংশগ্রহণের জন্য সনদ প্রদান করা হয়। মেলার মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তারা তাঁদের পণ্য প্রদর্শন, বাজার সম্প্রসারণ ও নতুন গ্রাহকদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের সুযোগ পেয়েছেন। এ ছাড়া, ছয়জন সম্মানিত নারী উদ্যোক্তাকে নিয়ে নির্মিত একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়, যা তাঁদের সংগ্রাম ও সাফল্যের গল্প তুলে ধরে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. খসরু পারভেজ বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বলেন, “নারী উদ্যোক্তারা দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করছেন। তাঁদের সাফল্য শুধু ব্যক্তিগত নয়, সমাজ ও দেশের জন্যও অনুপ্রেরণাদায়ক।” তিনি আরও জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ সুবিধা, প্রশিক্ষণ ও বাজার সংযোগের ক্ষেত্রে আরও উদ্যোগ নেবে।
নারী উদ্যোক্তাদের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, তবে তাঁদের সামনে এখনও রয়েছে নানা চ্যালেঞ্জ। মূলধনের অভাব, বাজার প্রবেশের সুযোগ, প্রশিক্ষণ ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা এখনও অনেক নারী উদ্যোক্তার পথে বাধা। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই ঋণ, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ও মেলার মতো উদ্যোগ এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
এই মেলার মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তারা তাঁদের পণ্যের বৈচিত্র্য ও গুণগত মান প্রদর্শনের সুযোগ পেয়েছেন। এ ছাড়া, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের সুযোগ তাঁদের ব্যবসায়িক দিগন্তকে আরও প্রসারিত করছে। বিশেষ করে, পরিবেশবান্ধব পণ্য ও স্থানীয় সম্পদের ব্যবহার তাঁদের ব্যবসাকে টেকসই করছে।
উপসংহার
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই উদ্যোগ নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে তাঁদের অবদানকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। ছয়জন নারী উদ্যোক্তার এই সম্মাননা অন্য নারীদের জন্যও অনুপ্রেরণার উৎস হবে। ভবিষ্যতে এ ধরনের মেলা ও উদ্যোগের ধারাবাহিকতা নারী উদ্যোক্তাদের আরও শক্তিশালী ও স্বাবলম্বী করে তুলবে।