যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে পথনকশা তৈরি করা হচ্ছে–বাণিজ্য উপদেষ্টা

বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে একটি সুনির্দিষ্ট পথনকশা প্রণয়নের কথা জানিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তিনি বলেছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কনীতি সংক্রান্ত আলোচনার বড় অংশ অনুমাননির্ভর হলেও বাণিজ্য ঘাটতির বাস্তবতা এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই ঘাটতি কমাতে স্পষ্ট হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে পণ্যের তালিকা এবং একটি কার্যকর পথনকশা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য ভারসাম্য উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করার আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) আয়োজিত বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে মাসিক ওয়েবিনারে মঙ্গলবার (৬ মে ২০২৫) সন্ধ্যায় এসব কথা বলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। ওয়েবিনারটি সঞ্চালনা করেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন। অনুষ্ঠানে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, এবং অবকাঠামো উন্নয়নের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়।
ট্রান্সশিপমেন্টে নতুন সম্ভাবনা
ওয়েবিনারে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আকাশপথে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার বিষয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টার কাছে জানতে চান। জবাবে শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, “ট্রান্সশিপমেন্ট প্রদানকারী দেশের খরচ সাধারণত উৎস দেশের তুলনায় কম হয়। এ কারণে বিভিন্ন দেশ এই সুবিধা গ্রহণ করে। তবে নতুন পরিস্থিতির আলোকে আমরা কিছু সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়েছি। এর ফলে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পণ্য পরিবহনে আমরা আরও দক্ষ ও প্রতিযোগীসক্ষম হতে পারব।”
তিনি আরও জানান, সম্প্রতি একটি নতুন কার্গো বিমানবন্দর চালু করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, এবং কক্সবাজারের বিমানবন্দরগুলোকে কার্গো পরিবহনের জন্য আরও কার্যকরভাবে ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে। কক্সবাজারে রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজ চলছে, যাতে বোয়িং ৭৪৭-৮০০ এর মতো বড় কার্গো বিমান অবতরণ করতে পারে। এছাড়া একটি দেশীয় এয়ারলাইনের জন্য নতুন বিমান অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এবং বিদেশি কার্গো পরিবহনকারী সংস্থাগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। এই লক্ষ্যে কিছু বিধিনিষেধ শিথিল করার উদ্যোগও নেওয়া হবে।
বিনিয়োগ বৃদ্ধির উদ্যোগ
দেশে বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করতে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। তিনি বলেন, “সরকারি মালিকানাধীন প্রায় ৩০টি পাটকল এবং সমসংখ্যক বস্ত্রকল বেসরকারি খাতে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এসব কারখানা ন্যূনতম ৩০ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হবে, এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রথম তিন বছর ভাড়ামুক্ত সুবিধা প্রদান করা হবে।” এই উদ্যোগের মাধ্যমে দেশী-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।
শস্য উৎপাদনের পর অপচয় কমাতে সরকার বাফার বা সংরক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে। শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, “দেশে শস্য উৎপাদনের পর অনেক অপচয় ঘটে। এটি কমাতে আমরা সংরক্ষণ ব্যবস্থা উন্নত করতে চাই। এই খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে।” তিনি জানান, সরকার ইতিমধ্যে এই খাতে বিনিয়োগের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
জ্বালানি সরবরাহের চ্যালেঞ্জ
জ্বালানি সরবরাহ ও দাম নিয়ে উদ্যোক্তাদের অসুবিধার বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, “দেশে গ্যাস বিতরণের জন্য একটি ভালো ব্যবস্থা রয়েছে। তবে পর্যাপ্ত রিগ্যাসিফিকেশন স্টেশনের অভাব রয়েছে। জ্বালানি মন্ত্রণালয় নতুন রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। এর মাধ্যমে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) এনে পাইপলাইনের মাধ্যমে বিতরণ করা সম্ভব হবে।”
তিনি ভোলায় বিনিয়োগের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে বলেন, “ভোলায় প্রাকৃতিক গ্যাসের উদ্বৃত্ত রয়েছে। যেকোনো আগ্রহী বিনিয়োগকারী এখানে এলে দ্রুত গ্যাস সংযোগ পেতে পারেন।” এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
বাণিজ্য সংগঠনের সংস্কার
দেশের বাণিজ্য সংগঠনগুলোর কাঠামোগত সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন শেখ বশিরউদ্দীন। তিনি বলেন, “আমরা সকল অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে সংস্কারের একটি খসড়া প্রস্তুত করেছি। এটি বর্তমানে আইন মন্ত্রণালয়ে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য রয়েছে।” তিনি অতীতে প্রভাবশালী গোষ্ঠীর দ্বারা বাণিজ্য সংগঠনের নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রবণতার সমালোচনা করে বলেন, “বাণিজ্য ও শিল্প সংগঠনগুলোর কার্যক্রম আরও গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালনা এবং যথাযথ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করছি।”
বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর কৌশল
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে সরকারের নেওয়া কৌশলগুলোর মধ্যে রয়েছে শুল্কহার হ্রাস, অশুল্ক বাধা দূরীকরণ, এবং মেধাস্বত্ব সুরক্ষা। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ১৯০টি পণ্যের উপর শুল্কহার শূন্য করেছে এবং আরও ১০০টি পণ্য যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া তুলা, সয়াবিন, এবং এলএনজি আমদানি বৃদ্ধির মাধ্যমে বাণিজ্য ভারসাম্য উন্নত করার চেষ্টা চলছে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, “আমাদের লক্ষ্য বাণিজ্য ঘাটতি কমানো। আমরা এখন দেখছি কোন কোন পণ্যের মাধ্যমে এই ঘাটতি কমানো যায়।” তিনি জানান, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে এই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
শেখ বশিরউদ্দীন আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, “আমাদের পথনকশা এবং বিনিয়োগ উদ্যোগগুলো সফল হলে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ভারসাম্য উন্নত করতে পারবে। এছাড়া দেশের অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার হবে।” তিনি বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের এটি একটি উপযুক্ত সময়।