কোরবানির পশুর চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ

আসন্ন ঈদুল আজহার সময় কোরবানির পশুর চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে এবং এই খাতে বিদ্যমান অব্যবস্থাপনা ও সিন্ডিকেটের প্রভাব দূর করতে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। এই নির্দেশনা গত রবিবার (৪ মে, ২০২৫) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে প্রদান করা হয়। এই উদ্যোগের মাধ্যমে কোরবানির পশুর চামড়ার বাজারে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সমাজের হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা ও বৈঠকের বিবরণ
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে কোরবানির পশুর চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ, পশু পরিবহন, হাটে বিক্রয় প্রক্রিয়া, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের সার্বিক বিষয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। এই বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, দীর্ঘদিন ধরে কোরবানির পশুর চামড়ার বাজারে অব্যবস্থাপনা ও সিন্ডিকেটের কারণে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী, ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
প্রফেসর ইউনূস বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে আমরা দেখছি মানুষ কোরবানির পশুর চামড়ার ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সমাজের হতদরিদ্র মানুষেরা, যারা এই চামড়া বিক্রির টাকার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। এই অব্যবস্থাপনার অবসান হওয়া প্রয়োজন।” তিনি আরও জানান, পশুর চামড়ার দাম নিয়ন্ত্রণে একটি সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব রয়েছে, যা ন্যায্য বাজার মূল্য প্রতিষ্ঠার পথে বাধা সৃষ্টি করছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, “আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো যাতে কোনো সিন্ডিকেট বা অব্যবস্থাপনার কারণে মানুষ কোরবানির পশুর চামড়ার ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত না হন।”
কমিটি গঠন ও এর গঠন
এই নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য প্রধান উপদেষ্টা বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। এই কমিটিতে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, প্রধান উপদেষ্টার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত বিশেষ সহকারী মো. খোদা বখস চৌধুরী, বিডা ও বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, শিল্প সচিব ওবায়দুর রহমান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি এবং চামড়া ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি।
এই কমিটির প্রধান লক্ষ্য হবে কোরবানির পশুর চামড়ার বাজারে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করা, সিন্ডিকেটের প্রভাব দূর করা এবং হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি সুনিশ্চিত করা। এছাড়াও, কমিটি পশু পরিবহন, হাটে বিক্রয় এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করবে।
পশু পরিবহন ও নৈতিক আচরণের উপর জোর
প্রধান উপদেষ্টা কোরবানির পশু পরিবহন এবং হাটে বিক্রয়ের সময় পশুর প্রতি নির্দয় আচরণ রোধে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, “কোরবানির পশু পরিবহন ও হাটে বিক্রির সময় যাতে পশুর প্রতি কোনো নির্দয় আচরণ করা না হয়, সেদিকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।” এই নির্দেশনা পশুদের প্রতি মানবিক আচরণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের একটি উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এছাড়াও, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি এবং ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার উপর জোর দেওয়া হয়। প্রধান উপদেষ্টা জানান, পরিবেশ দূষণ রোধ এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে চামড়া শিল্পে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চামড়া শিল্পের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
বাফলাদেশের চামড়া শিল্প দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। এই শিল্প বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি অন্যতম উৎস এবং এর সাথে জড়িত রয়েছে বিভিন্ন স্তরের ব্যবসায়ী ও শ্রমিক। তবে, দীর্ঘদিন ধরে চামড়ার বাজারে অব্যবস্থাপনা, সিন্ডিকেটের প্রভাব এবং ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণে ব্যর্থতার কারণে এই খাতের সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে, কোরবানির সময় চামড়ার দাম হ্রাস পাওয়ায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রধান উপদেষ্টার এই উদ্যোগ চামড়া শিল্পে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সঠিক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই খাতের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব। এছাড়াও, চামড়া শিল্পে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সিন্ডিকেটের প্রভাব দূরীকরণ এই খাতকে আরও টেকসই ও লাভজনক করে তুলতে পারে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব
কোরবানির পশুর চামড়ার বাজারে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণের এই উদ্যোগ সমাজের হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। অনেক দরিদ্র পরিবার কোরবানির চামড়া বিক্রির আয়ের উপর নির্ভর করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। এই উদ্যোগের ফলে তাদের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত হবে এবং সামাজিক বৈষম্য হ্রাস পাবে। এছাড়াও, সিন্ডিকেটের প্রভাব দূরীকরণের মাধ্যমে বাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবে, যা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্যও সুফল বয়ে আনবে।