জুন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হওয়া আইফোনের বড় অংশই হবে ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’

বিশ্বের অন্যতম দামি ও জনপ্রিয় স্মার্টফোন আইফোনের উৎপাদন ঘাঁটি হিসেবে ধীরে ধীরে ভারতের অবস্থান সুদৃঢ় হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে চলতি বছরের জুন প্রান্তিক থেকে যে পরিমাণ আইফোন বিক্রি হবে, তার বড় অংশই ভারতে উৎপাদিত হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন অ্যাপলের সিইও টিম কুক। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে ‘মেড ইন চায়না’ ট্যাগলাইন থেকে ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’তে বড় ধরনের মোড় নিচ্ছে অ্যাপলের উৎপাদন কৌশল।
এটি শুধু উৎপাদনের ভৌগোলিক স্থানান্তর নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধের এক নতুন অধ্যায়ের পরিণতি। অ্যাপল চীনের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ভারত ও ভিয়েতনামকে সামনে নিয়ে আসছে—যা বৈশ্বিক প্রযুক্তি শিল্পে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন।
চীনের পরিবর্তে ভারত ও ভিয়েতনামই অ্যাপলের নতুন ভরসা
অ্যাপলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, শুধু আইফোন নয়, আইপ্যাড, ম্যাক, অ্যাপল ওয়াচ ও এয়ার পডের মতো পণ্যগুলোর উৎপাদনও ধাপে ধাপে চীন থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে। এসব পণ্যের নতুন উৎপাদন ঘাঁটি হবে ভিয়েতনাম। অর্থাৎ অ্যাপলের অন্যতম প্রধান কারখানা গন্তব্য এখন দক্ষিণ এশিয়া।
বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এই কৌশল নতুন কিছু নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার শুল্কযুদ্ধ, জিওপলিটিক্যাল উত্তেজনা এবং উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বহু পশ্চিমা কোম্পানি চীনের বিকল্প খুঁজছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারত ও ভিয়েতনাম অগ্রসর দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাবেই ভারতে উৎপাদনে জোর
অ্যাপলের ভারতে উৎপাদন শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের বিরুদ্ধে প্রথম বড় বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেন। এরপর ধাপে ধাপে ফক্সকনসহ বিভিন্ন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ভারতের চেন্নাই ও বেঙ্গালুরুতে আইফোন উৎপাদনে যুক্ত হয়। এখন সেই উৎপাদন পৌঁছেছে পূর্ণমাত্রায়।
অ্যাপল জানায়, জুন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যেসব আইফোন বিক্রি হবে, তার “মেজর শেয়ার” (major share) হবে ভারত থেকে সরবরাহ করা। এটি শুধু অ্যাপলের অভ্যন্তরীণ কৌশল নয়, বরং একটি বৃহৎ বাণিজ্যিক কূটনৈতিক পদক্ষেপ, যাতে ভারত তার অবস্থান আরও সুদৃঢ় করতে সক্ষম হচ্ছে।
মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে ভারতের বিকল্প কার্যকর
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক সংক্রান্ত সর্বশেষ নির্দেশনা অনুসারে, জুন প্রান্তিকে চীন থেকে আমদানি করা প্রতিটি অ্যাপল পণ্যে গড়ে ২০% থেকে ১২৫% পর্যন্ত অতিরিক্ত শুল্ক আরোপিত হবে। যার সম্মিলিত বোঝা দাঁড়াতে পারে ১৪৫% পর্যন্ত। এই অতিরিক্ত শুল্কের কারণে চীনে উৎপাদিত একটি আইফোনের দাম যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে পৌঁছাবে প্রায় ২,৫০০ ডলার পর্যন্ত—যা ক্রেতা ও কোম্পানির উভয়ের জন্যই বড় বোঝা।
অন্যদিকে, ভারত থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর এই শুল্ক ৯ জুলাই পর্যন্ত স্থগিত রয়েছে। ফলে এই সময়টুকু অ্যাপলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই অ্যাপল ভারত থেকে রপ্তানির গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। মার্চের শেষ সপ্তাহে মাত্র তিন দিনের মধ্যে পাঁচটি বিমান বোঝাই আইফোন ও অন্যান্য পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়—এমন তথ্যই জানাচ্ছে রয়টার্স।
ভারতের উত্থান: শুধু উৎপাদনই নয়, বাজার হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ
অ্যাপলের জন্য ভারত কেবল উৎপাদনের জন্যই নয়, বরং ক্রমবর্ধমান এক বাজার হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিশাল জনসংখ্যা, মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রসার, এবং ৫জি সংযোগের মতো প্রযুক্তিগত সুযোগের কারণে ভারতের বাজার এখন অনেক বেশি সম্ভাবনাময়।
তবে অ্যাপল এখনো পর্যন্ত ভারতে উৎপাদিত আইফোন স্থানীয়ভাবে সীমিত পরিসরে বিক্রি করে। এই ক্ষেত্রে ব্যয় সাশ্রয় ও শুল্ক সুবিধার দিকটি বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয়ভাবে তৈরি পণ্যের স্থানীয় বিক্রি বাড়ানোর দিকেও নজর দিচ্ছে কোম্পানিটি। এর ফলে আইফোনের দাম ভারতে তুলনামূলক কম রাখা সম্ভব হবে।
মুনাফা বাড়াতে ভারতের গুরুত্ব
টিম কুক জানিয়েছেন, শুল্ক যুদ্ধ ও উৎপাদন স্থানান্তরের কারণে অ্যাপলের আমদানি খরচ ৯০০ মিলিয়ন ডলার বা ৯০ কোটি ডলার পর্যন্ত বাড়তে পারে। এমন পরিস্থিতিতে ভারত হয়ে উঠতে পারে অ্যাপলের মুনাফা বাড়ানোর প্রধান কৌশলগত উপায়।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, অ্যাপল যেভাবে উৎপাদন সরিয়ে নিচ্ছে, তাতে কোম্পানির ভবিষ্যৎ মুনাফা রক্ষা ও পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক দাম ধরে রাখার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে এটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক অংশীদারত্বও আরও গভীর করবে।
প্রযুক্তি শিল্পে এক নতুন ধারা
অ্যাপলের এই পদক্ষেপ গোটা প্রযুক্তি শিল্পের জন্য এক দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন বহু প্রযুক্তি কোম্পানিই তাদের সরবরাহ চেইন চীন থেকে সরিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছে। এতে ভারত ও ভিয়েতনাম সুবিধা পেতে শুরু করেছে।
বিশ্ব রাজনীতিতে চীন-মার্কিন উত্তেজনা বাড়তে থাকলে অ্যাপলের পথ ধরে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর দিকে ঝুঁকবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।