ট্রাম্পের শুল্কনীতিতে অ্যাপলের খরচ বাড়তে পারে ৯০০ মিলিয়ন ডলার

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক শুল্কনীতির প্রভাবে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি জায়ান্ট অ্যাপলের উৎপাদন খরচ প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পেতে পারে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) টিম কুক। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফ–এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এই শুল্কনীতির ফলে অ্যাপলের উৎপাদন কৌশল, বাজার প্রতিযোগিতা এবং ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতার ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে।
শুল্কনীতির প্রেক্ষাপট
ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কনীতি মূলত চীন থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর কেন্দ্রীভূত। অ্যাপলের মতো প্রতিষ্ঠান, যারা তাদের অধিকাংশ পণ্য যেমন আইফোন, আইপ্যাড এবং ম্যাকবুক চীনে উৎপাদন করে, তারা এই নীতির সরাসরি প্রভাবের মুখোমুখি হচ্ছে। বিশ্লেষকদের সঙ্গে এক আলোচনায় টিম কুক বলেন, “ভবিষ্যতে শুল্ক সংক্রান্ত পদক্ষেপ অনিশ্চিত হলেও, বর্তমান নীতির কারণেই আমাদের খরচ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে।” তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, নতুন করে শুল্ক আরোপ না হলেও, বিদ্যমান নীতি অ্যাপলের জন্য যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
বর্তমানে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর বিভিন্ন ধরনের শুল্ক আরোপ করেছে, যার মধ্যে স্মার্টফোন এবং কম্পিউটারের মতো পণ্যের ওপর ‘ফেন্টানিল শুল্ক’ নামে ২০ শতাংশ শুল্ক রয়েছে। যদিও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র স্মার্টফোন এবং কম্পিউটারকে ‘প্রতিশোধমূলক শুল্ক’ তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে, তবুও ‘ফেন্টানিল শুল্ক’ অ্যাপলের পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
অ্যাপলের উৎপাদন কৌশল এবং চীন নির্ভরতা
অ্যাপলের পণ্যের উৎপাদন ব্যবস্থা বহুলাংশে চীনের ওপর নির্ভরশীল। চীনের ফক্সকন, পেগাট্রন এবং উইস্ট্রনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো অ্যাপলের পণ্য উৎপাদনের মূল কারখানা হিসেবে কাজ করে। চীনের শ্রমবাজার, অবকাঠামো এবং সরবরাহ শৃঙ্খলের সুবিধার কারণে অ্যাপল দীর্ঘদিন ধরে এই দেশে উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। কিন্তু ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে এই মডেল এখন চাপের মুখে।
শুল্কনীতির প্রভাব মোকাবেলায় অ্যাপল ইতোমধ্যে তাদের উৎপাদনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ চীন থেকে ভারতে স্থানান্তর করছে। ভারতের তামিলনাড়ু এবং কর্ণাটক রাজ্যে অ্যাপলের কারখানাগুলোতে আইফোন উৎপাদন বাড়ছে। ফক্সকন এবং টাটা গ্রুপের মতো অংশীদারদের সঙ্গে অ্যাপল ভারতে তাদের উৎপাদন ক্ষমতা সম্প্রসারণ করছে। তবে, ভারতে উৎপাদন স্থানান্তর একটি জটিল এবং সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। বিশেষজ্ঞদের মতে, চীনের তুলনায় ভারতের অবকাঠামো এবং দক্ষ শ্রমবাজার এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত নয়, ফলে অ্যাপলের জন্য খরচ কমানোর এই কৌশল তাৎক্ষণিকভাবে ফলপ্রসূ হবে না।
আর্থিক প্রভাব এবং বিক্রির প্রবণতা
শুল্কনীতির কারণে অ্যাপলের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও, কোম্পানিটি ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে আশাতীত বিক্রি অর্জন করেছে। অ্যাপলের বিক্রি দাঁড়িয়েছে ৯৫.৪ বিলিয়ন ডলারে, যা আগের বছরের তুলনায় ৫ শতাংশ বেশি। এই সময়ে কোম্পানিটির মুনাফা হয়েছে ২৪.৮ বিলিয়ন ডলার। বিশ্লেষকদের মতে, ভবিষ্যতে পণ্যের দাম বাড়তে পারে এই আশঙ্কায় অনেক গ্রাহক আগেই আইফোন এবং অন্যান্য অ্যাপল পণ্য কিনেছেন, যা বিক্রি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
তবে, চীনের বাজারে অ্যাপলের বিক্রি কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে চীনে অ্যাপলের বিক্রি দাঁড়িয়েছে ১৬ বিলিয়ন ডলারে, যা আগের বছরের তুলনায় সামান্য কম। চীনের অর্থনৈতিক মন্দা এবং স্থানীয় ব্র্যান্ড যেমন হুয়াওয়ে এবং শাওমির সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে অ্যাপলের বাজার অংশীদারিত্ব কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ভোক্তা এবং বাজারের ওপর প্রভাব
শুল্কনীতির কারণে অ্যাপলের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেলে পণ্যের দাম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অ্যাপল তাদের মুনাফার হার ধরে রাখতে পণ্যের মূল্য বাড়াতে পারে, যা ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, যেখানে আইফোনের দাম ইতোমধ্যে অনেকের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে, দাম বৃদ্ধি অ্যাপলের বাজার অংশীদারিত্বের জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
অন্যদিকে, অ্যাপলের প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন স্যামসাং এবং গুগল, তাদের উৎপাদন কার্যক্রম বিভিন্ন দেশে বিস্তৃত করে শুল্কের প্রভাব কমানোর চেষ্টা করছে। ফলে অ্যাপলের তুলনায় তাদের পণ্যের দাম তুলনামূলকভাবে কম থাকতে পারে, যা বাজার প্রতিযোগিতায় অ্যাপলের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং ঝুঁকি
অ্যাপলের উৎপাদন কৌশলের পরিবর্তন এবং শুল্কনীতির প্রভাব মোকাবেলায় কোম্পানিটি বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। ভারত ছাড়াও অ্যাপল ভিয়েতনাম এবং ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে উৎপাদন সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে। তবে, এই দেশগুলোতে চীনের মতো উন্নত সরবরাহ শৃঙ্খল এবং অবকাঠামো না থাকায় অ্যাপলের জন্য খরচ বৃদ্ধির ঝুঁকি রয়েছে।
এছাড়া, ট্রাম্প প্রশাসনের ভবিষ্যৎ নীতি অনিশ্চিত। নতুন করে শুল্ক আরোপ বা বিদ্যমান শুল্কের হার বৃদ্ধি পেলে অ্যাপলের খরচ আরও বাড়তে পারে। বিশ্লেষকদের মতে, অ্যাপলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য দীর্ঘমেয়াদী সমাধান হতে পারে স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সরবরাহ শৃঙ্খলের বৈচিত্র্যকরণ।
উপসংহার
ট্রাম্পের শুল্কনীতি অ্যাপলের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ৯০০ মিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত খরচ কোম্পানিটির মুনাফা, পণ্যের দাম এবং বাজার প্রতিযোগিতার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। তবে, অ্যাপলের শক্তিশালী ব্র্যান্ড ইমেজ, উদ্ভাবনী পণ্য এবং কৌশলগত উৎপাদন পরিবর্তনের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সম্ভাবনা রয়েছে। ভবিষ্যতে শুল্কনীতির পরিবর্তন এবং অ্যাপলের পদক্ষেপ বিশ্ব প্রযুক্তি বাজারের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।