প্রক্রিয়াকরণের সময় নষ্ট হয় ১৭ শতাংশ লবণ

বাংলাদেশে উৎপাদিত অপরিশোধিত লবণের প্রায় ১৭ শতাংশ প্রক্রিয়াকরণের সময় নষ্ট হচ্ছে, যা দেশের লবণ শিল্পের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং ইনোভিশন কনসাল্টিং কোম্পানির একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণা অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ মৌসুমে উৎপাদিত ২.৮৩ মিলিয়ন টন অপরিশোধিত লবণ প্রক্রিয়াকরণের পর ২.৩৫ মিলিয়ন টনে নেমে আসবে। এই ক্ষতির পেছনে কৃষকদের অসচেতনতা, অপরিশোধিত লবণে ময়লা ও অতিরিক্ত পানির উপস্থিতি এবং প্রক্রিয়াকরণের সময় ত্রুটি প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
গত বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে ‘বাংলাদেশে লবণ খাতে কর্মপরিবেশ উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতীয় পরামর্শ সভায় লবণ চাষী ও শ্রমিকদের কল্যাণের অঙ্গীকার’ শীর্ষক এক সেমিনারে এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ গুলজারুল আজিজ এবং ইনোভিশন কনসাল্টিংয়ের পোর্টফোলিও ডিরেক্টর তাসমিয়া তাবাসসুম রহমান।
প্রক্রিয়াকরণে ক্ষতির পরিমাণ
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের অভ্যন্তরীণ লবণের চাহিদার ৯৫ শতাংশ পূরণ হয় স্থানীয় উৎপাদন থেকে। তবে প্রক্রিয়াকরণের সময় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ লবণ নষ্ট হওয়ায় উৎপাদনের পূর্ণ সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিবেদনে তিনটি মৌসুমের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে:
- ২০২৩-২৪ মৌসুম: উৎপাদিত ২.৬৪৮ মিলিয়ন টন অপরিশোধিত লবণ পরিশোধনের পর ২.১৯৮ মিলিয়ন টন পাওয়া গেছে।
- ২০২৪-২৫ মৌসুম: উৎপাদিত ২.৮৩ মিলিয়ন টন লবণ পরিশোধনের পর ২.৩৫ মিলিয়ন টন থাকবে।
- ২০২৫-২৬ মৌসুম (প্রাক্কলিত): উৎপাদন হবে ৩.০৪৮ মিলিয়ন টন, যা পরিশোধনের পর ২.৫৩ মিলিয়ন টনে নেমে আসবে।
এই তথ্য থেকে স্পষ্ট যে, প্রতি মৌসুমে গড়ে ১৭ শতাংশ লবণ প্রক্রিয়াকরণে নষ্ট হচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতি ও লবণ শিল্পের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
ক্ষতির কারণ
গবেষণায় লবণ নষ্ট হওয়ার বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রধানত কৃষকদের অসচেতনতা এবং প্রক্রিয়াকরণের ত্রুটি এই ক্ষতির জন্য দায়ী। অধ্যাপক মোহাম্মদ গুলজারুল আজিজ ব্যাখ্যা করেন, “মাঠ থেকে সংগৃহীত অপরিশোধিত লবণে ময়লা ও অতিরিক্ত পানির পরিমাণ বেশি থাকে। লবণের দানা পরিপক্ব হতে পাঁচ দিন সময় প্রয়োজন, কিন্তু অনেক কৃষক তিন দিনের মধ্যেই লবণ তুলে ফেলেন। এছাড়া, ওজন বাড়ানোর জন্য কেউ কেউ শুকানোর আগেই পানি ছিটিয়ে দেন, যা লবণের গুণগত মান নষ্ট করে।”
প্রক্রিয়াকরণের পর্যায়েও নানা ত্রুটি লক্ষ্য করা গেছে। পরিবহন, লোড-আনলোড এবং কারখানায় প্রক্রিয়াকরণের সময় লবণের একটি অংশ নষ্ট হয়। পরিশোধন প্রক্রিয়ায় ময়লা ও অতিরিক্ত পানি অপসারণের সময় লবণের ওজন কমে যায়, যা মোট ক্ষতির ১৭ শতাংশের জন্য দায়ী।
সমাধানের পথ
গবেষণায় লবণ নষ্ট কমানোর জন্য বেশ কিছু সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। কৃষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানো, লবণ সংগ্রহ ও শুকানোর প্রক্রিয়ায় উন্নত পদ্ধতি প্রয়োগ এবং পরিবহন ও প্রক্রিয়াকরণে সতর্কতা অবলম্বন এই ক্ষতি কমাতে সহায়ক হতে পারে। অধ্যাপক আজিজ বলেন, “লবণের দানা পরিপক্ব হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় দেওয়া এবং ওজন বাড়ানোর জন্য পানি ছিটানো বন্ধ করতে হবে। এছাড়া, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিশোধন প্রক্রিয়ার দক্ষতা বাড়ানো সম্ভব।”
ইনোভিশন কনসাল্টিংয়ের তাসমিয়া তাবাসসুম রহমান জানান, লবণ শিল্পে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ উন্নত করা এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। তিনি বলেন, “কৃষক ও শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে হলে প্রক্রিয়াগত ত্রুটি দূর করা এবং আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ জরুরি।”
অর্থনৈতিক প্রভাব
লবণ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৃষিজ পণ্য, যা দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার পাশাপাশি রপ্তানির সম্ভাবনাও তৈরি করেছে। তবে প্রক্রিয়াকরণে ১৭ শতাংশ ক্ষতি দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। গবেষণা অনুযায়ী, উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি ক্ষতি কমানো গেলে লবণ শিল্প আরও লাভজনক হতে পারে।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) এই খাতে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তবে, ক্ষতি কমাতে কৃষক, শ্রমিক এবং শিল্প সংশ্লিষ্টদের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।