‘গার্মেন্টস শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে গ্যাসের চাপ এবং সরবরাহ জরুরি’

সাভারের বিরুলিয়ায় অনুষ্ঠিত বিজিডব্লিউটিএফ-এর ১৪তম বার্ষিক মিলনমেলায় অংশ নিয়ে তৈরি পোশাক শিল্প নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি ও খাতটির বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ফারুক হাসান। তিনি বলেন, “গার্মেন্টস শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ এবং যথাযথ চাপ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।”
বৃহস্পতিবার (১ মে) বিকেলে অনুষ্ঠিত এই আয়োজনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। ফারুক হাসান জানান, দেশের প্রধান রপ্তানি খাত হিসেবে পরিচিত তৈরি পোশাক শিল্প বর্তমানে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যার অন্যতম প্রধান কারণ হলো গ্যাস সংকট।
তিনি বলেন, “আমরা সরকারের কাছে গ্যাসের দাম হ্রাস এবং নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য বারবার দাবি জানিয়েছি। কিন্তু বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ একেবারেই অনিয়মিত। কিছু কারখানায় তো গ্যাসই মিলছে না, আবার অনেক কারখানায় কাঙ্ক্ষিত চাপ পাওয়া যাচ্ছে না। এর ফলে উৎপাদন বিঘ্নিত হচ্ছে এবং রপ্তানি আদেশ পূরণে সময়মতো সক্ষম হচ্ছেন না উদ্যোক্তারা।”
গ্যাসের চাপ আশঙ্কাজনকভাবে কম
ফারুক হাসান আরও জানান, গার্মেন্টস কারখানাগুলোর চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের চাপ যেখানে হওয়া উচিত ছিল ১৫ পিএসআই, সেখানে অনেক জায়গায় তা নেমে এসেছে মাত্র ২-৩ পিএসআই বা তারও নিচে। কখনো কখনো চাপ একেবারেই শূন্যে নেমে আসছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। তিনি বলেন, “কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হলে স্থিতিশীল গ্যাস চাপ অপরিহার্য। কিন্তু যখন গ্যাসই থাকে না বা চাপ থাকে না, তখন উৎপাদন কার্যক্রম একরকম থমকে দাঁড়িয়ে যায়।”
তিনি আরও জানান, বর্তমানে দেশের নিজস্ব গ্যাস মজুদ হ্রাস পাচ্ছে। নতুন কোনো গ্যাস কূপ খননের কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়। এ অবস্থায় এলএনজি ও এলপিজির মতো বিকল্প উৎস থেকে গ্যাস আমদানি ছাড়া কোনো উপায় নেই। একইসঙ্গে, আগামী দিনের কথা বিবেচনা করে দ্রুত নতুন গ্যাস কূপ খননের উদ্যোগ নিতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত
গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে ইতোমধ্যেই বহু তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানান ফারুক হাসান। তিনি বলেন, “শুধু উদ্যোক্তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না, হাজার হাজার শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। এ খাতে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে কোটি মানুষের জীবিকা জড়িত। তাই এর সংকট মানে দেশের অর্থনীতির সংকট।”
বর্তমানে গার্মেন্টস শিল্পে কাজ করা শ্রমিকদের একটি বড় অংশ চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন পার করছেন। উৎপাদন ব্যাহত হলে শ্রমিকদের ওভারটাইম বন্ধ হয়ে যায়, বোনাসে কাটছাঁট পড়ে, এমনকি কিছু কিছু কারখানায় সময়মতো বেতন পরিশোধ করাও কঠিন হয়ে পড়ে।
চ্যালেঞ্জকে সুযোগে রূপান্তরের আহ্বান
ফারুক হাসান বলেন, “দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আমাদেরকে এসব চ্যালেঞ্জকে সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করতে হবে এবং সেগুলোকে সুযোগে রূপান্তর করতে হবে। এজন্য উদ্যোক্তা, সরকার, শ্রমিক—সব পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, তৈরি পোশাক শিল্প হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস। এই খাতই দেশের প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার অন্যতম চালিকাশক্তি। তাই গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোগত সমস্যাগুলো সমাধান না হলে পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই ঝুঁকিতে পড়বে।
মিলনমেলায় পোশাক খাতের উপস্থিতি
বিজিডব্লিউটিএফের ১৪তম বার্ষিক এই মিলনমেলায় পোশাক শিল্পের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি, উদ্যোক্তা ও কারখানা কর্মীরা অংশগ্রহণ করেন। দিনব্যাপী চলা এই অনুষ্ঠানে গার্মেন্টস খাতের বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে মুক্ত আলোচনা হয়। পাশাপাশি, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ও পুরস্কার বিতরণীর মধ্য দিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে দিনটি পালন করা হয়।
বিজিডব্লিউটিএফের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এ ধরনের আয়োজন শিল্পের সঙ্গে যুক্তদের মধ্যে যোগাযোগ ও সহযোগিতার বন্ধন দৃঢ় করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। এছাড়া, অংশগ্রহণকারীদের অভিজ্ঞতা ও সমস্যা ভাগাভাগির মাধ্যমে নীতিনির্ধারকদের কাছে প্রাসঙ্গিক বার্তা পৌঁছে দেওয়াও এর অন্যতম উদ্দেশ্য।
সরকারের প্রতি আহ্বান
অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া উদ্যোক্তারা সরকারকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। তাদের মতে, এখনই যদি গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে স্থায়ী উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে রপ্তানি হ্রাস পাবে, কর্মসংস্থান কমবে এবং অর্থনীতি চরম চাপে পড়বে।
ফারুক হাসান বলেন, “এই শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে নীতি নির্ধারণে বাস্তবতা বিবেচনায় নিতে হবে। গ্যাস ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারলে শিল্প ধ্বংসের মুখে পড়বে।”
তবে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, “বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতের সক্ষমতা, অভিজ্ঞতা ও শ্রমিকদের পরিশ্রম আমাদের বড় শক্তি। সরকার ও বেসরকারি খাত একযোগে কাজ করলে আমরা যেকোনো সংকট মোকাবিলা করতে পারবো।”