বানিজ্য

বাংলাদেশ এখন আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল নয় : অর্থ উপদেষ্টা

বাংলাদেশ এখন আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল নয় বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমদ। মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) বিকেলে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।

তিনি জানান, “আমরা এখন আর আগের মতো আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের শর্তে পরিচালিত হই না। অর্থনীতি এখন অনেক বেশি পরিণত। আমরা সব শর্ত মেনে ঋণ নিতে চাই না।”

অর্থ উপদেষ্টার এই বক্তব্য অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অগ্রগতির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিফলন বলে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। বিশেষ করে চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ যে নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা এই বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

ঋণ চাওয়া হলেও শর্তে আপোষ নয়

অর্থ উপদেষ্টা জানান, সরকার বাজেট সহায়তা হিসেবে আইএমএফ-এর কাছে ১.২ বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে। এই বিষয়ে সংস্থাটির ইতিবাচক সাড়া মিলেছে। তাছাড়া ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ একসঙ্গে ছাড়ের বিষয়ে আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে।

তবে তিনি স্পষ্ট করেন যে, এই ঋণ গ্রহণ সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের শর্ত ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে হওয়া উচিত। তিনি বলেন, “আমরা চাই না, এমন কিছু শর্ত মেনে চলতে যা আমাদের অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের পরিপন্থী।”

পরিপক্ব অর্থনীতি, স্বাধীন সিদ্ধান্ত

ড. সালেহউদ্দিন বলেন, “আমাদের অর্থনীতি এখন অনেক বেশি পরিপক্ব। আমরা আমাদের রাজস্ব আয় বাড়িয়েছি, রপ্তানি বহুমুখীকরণ করেছি, রেমিট্যান্স প্রবাহ বজায় রয়েছে। তাই আমরা আর এমন অবস্থায় নেই যে, কেবল বাইরের সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে হবে।”

তিনি আরো বলেন, “আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতা আমরা চাই, তবে সেটি যেন সম্মানজনক হয় এবং আমাদের নীতি ও স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।”

বৈশ্বিক বাণিজ্য ও শুল্কনীতি নিয়ে প্রস্তুতি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতি তিন মাসের জন্য স্থগিত থাকায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন করলে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “বাংলাদেশ এই শুল্কনীতিকে ইতিবাচকভাবে দেখছে। আমরা এমন বড় দেশের সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে তর্কে যেতে চাই না। আমরা চাচ্ছি, ইতিবাচক কূটনৈতিকভাবে বিষয়টি মোকাবিলা করতে।”

তিনি আরও জানান, আগামী তিন মাস পর ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্ক নীতির আলোকে বাংলাদেশ প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং বাণিজ্যিকভাবে সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত করে তা মোকাবিলার কৌশল নির্ধারণ করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে ইতোমধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

আইএমএফের সঙ্গে চলমান আলোচনা

অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আইএমএফের সঙ্গে বাংলাদেশের চলমান আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। বাজেট সহায়তা ছাড়াও আর্থিক খাত সংস্কার, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা, বৈদেশিক ঋণ ব্যয় কমানো এবং সুশাসনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ যদি বাস্তবভিত্তিক ও সুপরিকল্পিতভাবে এই ঋণ চুক্তিগুলো বাস্তবায়ন করে, তাহলে তা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হবে। তবে শর্ত গ্রহণে অতীতের মতো তাড়াহুড়ো না করাটা নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ বলে মনে করছেন তারা।

নীতিগত পরিবর্তন এবং কাঠামোগত সংস্কার

অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার কথা বললেও, ড. সালেহউদ্দিন স্বীকার করেছেন যে দেশের আর্থিক খাত ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় কিছু কাঠামোগত দুর্বলতা রয়ে গেছে। তিনি বলেন, “আমরা কর আদায় ব্যবস্থা শক্তিশালী করছি, ডিজিটাল রাজস্ব প্রশাসন গড়ে তোলা হচ্ছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সংস্কার চলছে।”

বিশ্লেষকদের মতে, যদি এই সংস্কার প্রক্রিয়াগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয়, তাহলে আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য পূরণে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করতে পারবে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ভবিষ্যতে আর্থিক সহযোগিতা নেওয়ার ক্ষেত্রে বিকল্প উৎস বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ ছাড়াও এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (AIIB), ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (IDB), এবং ব্রিকস ব্যাংকের মতো সংস্থার সঙ্গেও আলাপ-আলোচনা হচ্ছে।

অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “আমাদের কৌশলগত লক্ষ্য হলো, যেকোনো আন্তর্জাতিক অর্থায়নের ক্ষেত্রে আমরা যেন আমাদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে পারি। আমরা কারও ওপর নির্ভর করতে চাই না, বরং অংশীদারিত্ব ভিত্তিক উন্নয়ন সহযোগিতা চাই।”

উপসংহার

বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় যেভাবে সরকার জাতীয় স্বার্থের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের শর্তাবলী নিয়ে সতর্কতা অবলম্বন করছে, তা ভবিষ্যতের জন্য একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। অর্থ উপদেষ্টার বক্তব্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আত্মনির্ভরতা অর্জন শুধু স্বপ্ন নয়, সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর নীতির মাধ্যমে তা বাস্তব করা সম্ভব।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button