বানিজ্য

২০২৭ সালের জুনের পর ‘করছাড়’ থাকবে না

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ২০২৭ সালের জুনের পর করছাড় প্রথার অবসান ঘটাতে চূড়ান্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সংস্থাটির মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব কৌশলে এই সিদ্ধান্তকে ‘উচ্চ অগ্রাধিকার’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজস্ব আদায়ে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করা এবং জাতীয় বাজেটে নির্ভরযোগ্যতা বৃদ্ধি করা।

করছাড় সংস্কার কেন জরুরি

বর্তমানে এনবিআর প্রতিবছর প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকার করছাড় দেয় বিভিন্ন খাতকে। আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), সম্পূরক শুল্ক, আমদানি শুল্ক ও আবগারি শুল্ক মিলিয়ে এই ছাড়ের পরিমাণ বিশাল অঙ্কে পৌঁছেছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এই ছাড় না দিলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামোসহ বিভিন্ন উন্নয়ন খাতে রাষ্ট্র আরও বেশি বিনিয়োগ করতে পারত।

এনবিআরের হিসাব বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে আয়কর আদায় হয়েছিল ৮৭ হাজার ৮৭১ কোটি টাকা, কিন্তু ছাড় দেওয়া হয়েছিল ১ লাখ ১৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ আদায়ের চেয়েও প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা বেশি করছাড় দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছরে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্কে ছাড় দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ২৯ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা, যেখানে আদায় ছিল ১ লাখ ৫৮ হাজার ১৮১ কোটি টাকা।

এই করছাড়ের অধিকাংশই চলে যায় সুবিধাভোগী শ্রেণি ও বড় শিল্প গোষ্ঠীর হাতে। এতে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) রাজস্ব ঘাটতি তৈরি হয় এবং করের ভার সাধারণ নাগরিকদের ওপর পড়ে। তাই এনবিআর মনে করছে, কর ব্যবস্থায় ন্যায়সঙ্গত ভারসাম্য আনার জন্য করছাড় সংস্কার অত্যাবশ্যক।

আইএমএফ-এর শর্ত ও কৌশলগত পরিবর্তন

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে করা ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তির অন্যতম শর্ত হলো—করছাড় হ্রাস করে রাজস্ব ঘাটতি কমানো। এই পরিপ্রেক্ষিতেই এনবিআর ১০ বছর মেয়াদি একটি ‘মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব কৌশল’ তৈরি করেছে। এই কৌশলে বলা হয়েছে, ২০২৭ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকের পর শুধুমাত্র আইনানুগ করছাড়ই থাকবে, দীর্ঘদিন ধরে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেওয়া করছাড় থাকবে না।

গত পাঁচ দশকে দুই শতাধিক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিভিন্ন খাতে করছাড় দেওয়া হয়েছে। এখন এসব প্রজ্ঞাপন পর্যায়ক্রমে বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এনবিআরের একটি বিশেষায়িত দল ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে এই সংস্কার বাস্তবায়নে।

করছাড় কমাতে নেওয়া হচ্ছে পাঁচটি উদ্যোগ

এনবিআরের পরিকল্পনায় আগামী দুই বছরের মধ্যে নিচের পাঁচটি পদক্ষেপ বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে:
১. খাতভিত্তিক করছাড় চিহ্নিত করা: কোন খাতে কী পরিমাণ করছাড় দেওয়া হয়, তা বিশ্লেষণ করে একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করা হবে।
২. করছাড় পর্যালোচনা ও যৌক্তিক হারে হ্রাস: সব খাতের করছাড় পর্যালোচনা করে অপ্রয়োজনীয় ছাড় ধাপে ধাপে হ্রাস করা হবে।
৩. বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয়: যেসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ করছাড় প্রস্তাব দেয়, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সমন্বিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
৪. একটি মানসম্পন্ন পরিচালন বিধান তৈরি: করছাড় হ্রাস ও নতুন করহার কার্যকরের জন্য একটি কার্যকর বিধান তৈরি করা হবে।
৫. ভ্যাটছাড় পর্যায়ক্রমে তুলে দেওয়া: ভ্যাটের ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় ধাপে ধাপে তুলে নেওয়ার কাজ শুরু হবে।

এই কার্যক্রম পরিচালনা করবে এনবিআরের তিনটি প্রধান বিভাগ—করনীতি, ভ্যাটনীতি ও কাস্টমস নীতি। লক্ষ্য হলো ২০২৭ সালের জুনের মধ্যেই সব কার্যক্রম সম্পন্ন করা।

কোন খাতে কত ছাড় দেওয়া হয়?

এনবিআরের তথ্যমতে, সবচেয়ে বেশি করছাড় দেওয়া হয় ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক খাতে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ লাখ ২৯ হাজার ৫৭০ কোটি টাকার ছাড় দেওয়া হয়, যা আদায়ের প্রায় ৮২ শতাংশ। একই সময়ে আয়কর ছাড়ের পরিমাণ ছিল আদায়ের তুলনায় ২৮ হাজার কোটি টাকা বেশি।

এছাড়া আমদানি শুল্ক ও আবগারি শুল্ক মিলিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে আদায় হয়েছে ৩৭ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা, যা ছাড়ের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম।

এই করছাড়ের মূল কারণ হলো বিভিন্ন শিল্প খাতকে উৎপাদন ও বিনিয়োগে উৎসাহিত করা। তবে অনেক ক্ষেত্রে ছাড়টি দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর না হয়ে রাষ্ট্রের রাজস্ব ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কী হতে পারে প্রভাব

বিশেষজ্ঞদের মতে, করছাড় হ্রাসের ফলে শুরুতে কিছু খাতে উৎপাদন ব্যয় বাড়তে পারে এবং কিছু উদ্যোক্তা ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন। তবে মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদে করনীতিতে স্বচ্ছতা আসবে এবং রাজস্ব ঘাটতি কমবে। এতে সরকারের আর্থিক সক্ষমতা বাড়বে এবং সামাজিক খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে।

তবে করছাড় হ্রাস কার্যকর করতে হলে এনবিআরকে অবশ্যই কর ব্যবস্থা সহজ, স্বচ্ছ ও ব্যবসাবান্ধব করতে হবে। কর দেওয়ার পদ্ধতি সহজ হলে কর ফাঁকি কমে আসবে এবং রাজস্ব আদায় বাড়বে।

শেষ কথা

২০২৭ সালের জুনের পর করছাড় প্রথার অবসান দেশের করনীতিতে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে যাচ্ছে। এটি শুধু এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের কৌশল নয়, বরং সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক ন্যায্যতা ও স্থিতিশীলতার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। কর ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় এই উদ্যোগ কতটা সফল হয়, সেটিই এখন দেখার বিষয়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button