ব্র্যান্ডের পণ্যের উৎপাদন মূল্য ফাঁস: চীনা উৎপাদকদের অভিনব প্রচারণা

বিশ্বের নামীদামি ব্র্যান্ডের পণ্য কত দামে বিক্রি হয় আর কত খরচে তৈরি হয়—এই পার্থক্য নিয়ে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন চীনের উৎপাদকরা। বিশেষ করে টিকটকের মাধ্যমে তাঁরা প্রকাশ করছেন বিলাসবহুল পণ্যের আসল উৎপাদন খরচ, যা চমকপ্রদভাবে কম। ফলে ভোক্তাদের মধ্যে নতুন করে প্রশ্ন উঠছে—ব্র্যান্ডের জন্য এত বেশি অর্থ ব্যয় কি যুক্তিসঙ্গত?
বিলাসবহুল ব্র্যান্ডের প্রকৃত উৎপাদন ব্যয়
গুচির একটি বেল্ট, যেটি পশ্চিমের বাজারে ৭০০ ডলারে বিক্রি হয়, চীনে তার উৎপাদন খরচ মাত্র ২০ থেকে ২৫ ডলার। আবার গুচির একটি টি–শার্টের বাজারমূল্য ৪০০ ডলার হলেও উৎপাদন খরচ মাত্র ২০ ডলার।
একইভাবে, বিশ্ববিখ্যাত বার্কেনস্টক স্যান্ডেলের দাম যুক্তরাষ্ট্রে ১২০ ডলার হলেও, চীনা উৎপাদকদের দাবি, এর উৎপাদন ব্যয় ২০ ডলারেরও কম।
সবচেয়ে আলোচিত হয়েছে হাই-এন্ড বারকিন ভ্যানিটি ব্যাগের তথ্য। বাজারে যেটির দাম ৩৮ হাজার ডলার, তার উৎপাদন খরচ মাত্র ১ হাজার ৪০০ ডলার বলে দাবি করেছেন চীনা উৎপাদকরা। তাঁরা সরাসরি ক্রেতাদের এই ব্যাগ কারখানা মূল্যে কেনার আহ্বানও জানিয়েছেন।
চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম-ভিত্তিক প্রচারণা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে চীনা উৎপাদকরা টিকটকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে অভিনব প্রচারণায় নেমেছেন। তাঁরা ব্যাগ, বেল্ট, জুতা থেকে শুরু করে আইফোনের মতো ইলেকট্রনিক পণ্যেরও আসল উৎপাদন খরচ প্রকাশ করছেন। এই কৌশলের মাধ্যমে তাঁরা সরাসরি পশ্চিমা ভোক্তাদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন এবং ব্র্যান্ডের ‘মূল্য ধারণা’ বা পারসেপশন অব ভ্যালু ভেঙে দিচ্ছেন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এটি একুশ শতকের অন্যতম বড় অর্থনৈতিক যুদ্ধ। চীন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বাজার নয়, বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ড সচেতনতাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
ব্র্যান্ডের পণ্য কেন এত দামি?
প্রশ্ন আসে—যদি উৎপাদন ব্যয় এত কম হয়, তবে দাম এত বেশি কেন?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দামি ব্র্যান্ডের পেছনে রয়েছে একটি বৃহৎ মানসিক খেলা। উচ্চবিত্ত শ্রেণির অনেকেই সমাজে নিজেদের পৃথকভাবে তুলে ধরার জন্য দামি ব্র্যান্ডের পণ্য ব্যবহার করেন। বারকিন ব্যাগ হাতে কেউ কোনো পার্টিতে গেলে বা লুই ভুইটনের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে হাঁটলে, তার সামাজিক অবস্থান স্বাভাবিকভাবেই আলাদা করে চিহ্নিত হয়।
এছাড়া ব্র্যান্ড মানেই নির্ভরযোগ্যতা ও গুণগত মানের প্রতিশ্রুতি। সাশ্রয়ী মূল্যের পণ্য থেকেও অনেকে নিরাপত্তা ও দীর্ঘস্থায়ীত্বের জন্য নামীদামি ব্র্যান্ডের দিকেই ঝুঁকেন।
চীনা প্রচারণার বিশ্বাসযোগ্যতা কতটুকু?
তবে চীনা উৎপাদকদের এই তথ্যপ্রকাশ নিয়ে প্রশ্নও উঠছে। অনেক সময় চীনা উৎপাদকরা নকল পণ্য তৈরি করে থাকেন। ফলে টিকটকে দেখা পণ্যগুলো আসল ব্র্যান্ডের মান মেনে তৈরি হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়া কঠিন।
ইউনিভার্সিটি অব আর্টস লন্ডনের অধ্যাপক রেজিনা ফ্রেই সিএনএনকে বলেন, এই প্রশ্নের উত্তর “হ্যাঁ” এবং “না”—দুটিই হতে পারে। কারণ, বাস্তবে অনেক বিলাসী ব্র্যান্ড চীনে উৎপাদিত হলেও মান নিয়ন্ত্রণ করে নিজস্ব কারখানা বা অনুমোদিত উৎপাদকদের মাধ্যমে। কিন্তু টিকটকের বিক্রয়কেন্দ্র থেকে কিনলে সেই মান নিশ্চয়তা পাওয়া কঠিন।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—এই প্রচারণার মাধ্যমে চীন নিজেদের নতুনভাবে তুলে ধরতে চাইছে। এতদিন তারা ‘সস্তা ও নকল পণ্য প্রস্তুতকারক’ হিসেবে পরিচিত ছিল। এখন তারা প্রমাণ করতে চাইছে, বিলাসবহুল পণ্য তৈরির ক্ষমতাও তাদের রয়েছে।
মার্কিন ব্র্যান্ডগুলোর জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ
চীনের এই পদক্ষেপ মার্কিন ব্র্যান্ডগুলোর জন্য বড় বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরাসরি উৎপাদন খরচ প্রকাশিত হওয়ার ফলে ব্র্যান্ড ইকুইটি বা ব্র্যান্ডের প্রতি ভোক্তাদের আস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, দামি ব্র্যান্ডগুলোর ক্ষেত্রে ভোক্তার মনে থাকা ‘বিলাসের ধারণা’ বা লাক্সারি ইমেজ নষ্ট হয়ে গেলে বাজারে তাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে।
সংক্ষেপে, চীনের উৎপাদন খরচ প্রকাশের কৌশল বিশ্ববাণিজ্যে এক নতুন উত্তাপ ছড়িয়েছে। ভবিষ্যতে এই প্রচারণার প্রভাব কতদূর বিস্তৃত হয়, তা সময়ই বলে দেবে।