বাণিজ্য লক্ষ্য অর্জনে ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসার আহ্বান উপদেষ্টার

বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্য লক্ষ্য অর্জনের জন্য উভয় দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তিনি বলেছেন, দুই দেশের মধ্যে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি এগুলো যৌক্তিক করার উপায় খুঁজে বের করা প্রয়োজন। এই প্রক্রিয়ায় পাকিস্তান-বাংলাদেশ বিজনেস ফোরাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি। সোমবার রাজধানীর একটি তারকা হোটেলে ‘পাকিস্তান-বাংলাদেশ বিজনেস ফোরাম’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।
বাণিজ্য সম্পর্কে নতুন গতি
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে প্রত্যাশিত মাত্রায় পৌঁছায়নি। জনবহুল এই দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিবেচনায়, বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়ানোর বিপুল সুযোগ রয়েছে। শেখ বশিরউদ্দীন তার বক্তব্যে বলেন, “পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য প্রত্যাশিত মাত্রায় না হওয়া দুঃখজনক। এই লক্ষ্য অর্জনে ব্যবসায়ীদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।” তিনি আরও জানান, পাকিস্তান-বাংলাদেশ বিজনেস ফোরাম ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও বাণিজ্য সংস্থাগুলোর মধ্যে সংযোগ স্থাপন, বাণিজ্য প্রসার এবং বিনিয়োগের সুযোগ অন্বেষণের একটি কার্যকর প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে।
অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা শুল্ক ও অশুল্ক বাধার বিষয়টি উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, “দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়াতে হলে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা প্রয়োজন। এই বাধাগুলো কীভাবে যৌক্তিক করা যায়, তা নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে।” এই প্রক্রিয়ায় সরকার, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টার ওপর জোর দেন তিনি।
দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর
অনুষ্ঠানের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) এবং পাকিস্তান রেডিমেড গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (পিআরজিএমইএ)-এর মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর। এই সমঝোতা স্মারক দুই দেশের পোশাক শিল্পের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিজিএমইএর পক্ষে প্রশাসক ও বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন এবং পিআরজিএমইএর পক্ষে ভাইস চেয়ারম্যান আমির রিয়াজ ছোট্টানি সমঝোতা স্মারকে সই করেন। এই চুক্তি পোশাক শিল্পে প্রযুক্তি বিনিময়, যৌথ বিনিয়োগ এবং বাজার সম্প্রসারণে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানের হাই কমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ উপস্থিত ছিলেন। তিনি দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে নিজ দেশের প্রতিশ্রুতির কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। এছাড়া, ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)-এর প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান এবং বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)-এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা সবাই বাণিজ্য সম্প্রসারণে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের সক্রিয় অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
বাংলাদেশ-পাকিস্তান বাণিজ্য: বর্তমান চিত্র
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে সীমিত পরিসরে রয়েছে। বাংলাদেশ প্রধানত পাকিস্তান থেকে তুলা, চামড়া এবং খাদ্যপণ্য আমদানি করে, আর পাকিস্তানে রপ্তানি করে পোশাক, পাটজাত পণ্য এবং কৃষিপণ্য। তবে, উভয় দেশের বাজারের সম্ভাবনা এবং জনসংখ্যার বিশালতা বিবেচনায় বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়ানোর বিপুল সুযোগ রয়েছে।
গত কয়েক বছরে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কে উন্নতি হয়েছে, যা বাণিজ্য সম্পর্কে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কে নতুন গতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই সময়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচের ঢাকা সফর এই সম্পর্ককে আরও জোরদার করেছে।
শুল্ক ও অশুল্ক বাধা: চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দুই দেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণের পথে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। উচ্চ শুল্ক হার, জটিল আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া এবং অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা বাণিজ্য প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে। উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন এই বাধাগুলো যৌক্তিক করার জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হবে বাণিজ্য প্রক্রিয়াকে সহজ করা এবং ব্যবসায়ীদের জন্য বাধা কমানো।”
এই লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ১০০টি পণ্যের ওপর শূন্য শুল্ক সুবিধা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে, যা অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদারে উভয় দেশের সরকার এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের সমন্বিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তান-বাংলাদেশ বিজনেস ফোরাম এই প্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া, দুই দেশের মধ্যে আরও উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক এবং কূটনৈতিক সফর বাণিজ্য সম্পর্কে নতুন গতি যোগ করবে।
উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন তার বক্তৃতায় বলেন, “আমাদের লক্ষ্য শুধু বাণিজ্য বাড়ানো নয়, বরং দুই দেশের মানুষের জীবনমান উন্নত করা। এই লক্ষ্যে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।” তাঁর এই আহ্বান বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বাণিজ্য সম্পর্কে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।