বানিজ্য

বিএসইসির নজরে ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টসের শেয়ার কারসাজি

মাত্র ১৬ দিনে ৯৩ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি—পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টস ব্লেন্ডার্স পিএলসি-র শেয়ারদরে এমন অস্বাভাবিক উত্থান বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বিষয়টিকে ‘সন্দেহজনক’ মনে করে ইতিমধ্যে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে।

পুঁজিবাজারের স্বাভাবিক নিয়মে কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম দ্রুত ওঠা-নামা করলে তা পর্যবেক্ষণ করা হয়। কিন্তু ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টসের ক্ষেত্রে যে হারে দর ও লেনদেন বেড়েছে, তা থেকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কারসাজির আশঙ্কা করছে।

শেয়ারদরে উত্থান: ১৬ দিনে ১,২৪৬ টাকার বেশি বৃদ্ধি

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২৭ ফেব্রুয়ারি ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টসের শেয়ারদর ছিল ১,৩৩৭ টাকা ৬০ পয়সা। মাত্র ১৬ দিনের ব্যবধানে অর্থাৎ ১৫ এপ্রিল তা বেড়ে দাঁড়ায় ২,৫৮৪ টাকা ৫০ পয়সায়।

এ অর্থাৎ, প্রতি শেয়ারে মূল্য বেড়েছে ১,২৪৬ টাকা ৯০ পয়সা বা ৯৩ দশমিক ২১ শতাংশ। এই সময়ের মধ্যে লেনদেনের পরিমাণও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। ২৭ ফেব্রুয়ারি যেখানে শেয়ার লেনদেনের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩,০৪২টি, সেখানে ২৪ মার্চ তা দাঁড়ায় ৫৩,৪৩৮টিতে।

বিএসইসির পদক্ষেপ: তদন্তের নির্দেশ

বাজারে এমন অস্বাভাবিক পরিবর্তনের পেছনে কোনো অনিয়ম আছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে বিএসইসি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের চিফ রেগুলেটরি অফিসার (সিআরও) কে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে।

বিএসইসি-র সার্ভেল্যান্স বিভাগ থেকে গতকাল রোববার একটি চিঠি ইস্যু করে বলা হয়, ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে বিস্তারিত তদন্ত প্রতিবেদন কমিশনে দাখিল করতে হবে। একই সঙ্গে ব্রোকারেজ হাউসগুলোর অনুমোদিত প্রতিনিধি (এআর), কমপ্লায়েন্স অফিসার ও সিইওদের এ বিষয়ে অবহিত করার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে, যেন সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন না হয়।

কোম্পানির ব্যাখ্যা: মূল্য সংবেদনশীল কোনো তথ্য নেই

ডিএসই কর্তৃপক্ষ ২৪ মার্চ কোম্পানির কাছে চিঠি পাঠিয়ে শেয়ারের অস্বাভাবিক উত্থানের কারণ জানতে চায়। পরদিন কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়, তাদের কাছে কোনো ‘মূল্য সংবেদনশীল অপ্রকাশিত তথ্য (PSI)’ নেই যা শেয়ারের দাম বৃদ্ধির কারণ হতে পারে।

তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হয়নি। তাই স্বতন্ত্র তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা জানার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টস: রাষ্ট্রায়ত্ত পটভূমি

ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টস ব্লেন্ডার্স পিএলসি বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অধীন একটি কোম্পানি। এখানে সরকারের মালিকানা রয়েছে ৫১ শতাংশ।

মূলত বিভিন্ন ধরনের লুব্রিকেন্ট তৈরির সঙ্গে যুক্ত এই প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে। সাধারণত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে বড় ধরনের অস্থিরতা তুলনামূলক কম দেখা যায়। তাই বর্তমান উল্লম্ফন স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে বলেই মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

সম্ভাব্য কারসাজি: বিনিয়োগকারীদের সতর্কবার্তা

বিএসইসি-র একজন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, “শেয়ার নিয়ে কারসাজি চলছে বলে আমাদের সন্দেহ রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের অবশ্যই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।”

এ ধরনের কারসাজির মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ঠকানোর ঝুঁকি থাকে। কারণ কৃত্রিমভাবে দর বাড়ানোর পর হঠাৎ দরপতন ঘটানো হয়, যাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন।

ডিএসই কর্তৃপক্ষের ভূমিকা

ডিএসই-র চিফ রেগুলেটরি অফিসার (সিআরও) খায়রুল বাশার আবু তাহের মোহাম্মদের কাছে এ বিষয়ে জানতে ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। ফলে তাঁর মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে ডিএসইর দায়িত্ব হলো বাজারে কোনো সন্দেহজনক লেনদেন শনাক্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে সহায়তা করা।

কেন সন্দেহের দৃষ্টি?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত কোনো কোম্পানির নতুন প্রকল্প গ্রহণ, বড় ধরনের চুক্তি, কর মওকুফ বা লাভজনক ঘোষণার পর শেয়ারের দর বাড়া স্বাভাবিক। কিন্তু যখন কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য ছাড়া অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে, তখনই কারসাজির সন্দেহ প্রবল হয়।

এই ক্ষেত্রে ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টস কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে যে, তাদের কাছে এমন কোনো তথ্য নেই। তবুও শেয়ারদরে এবং লেনদেনের পরিমাণে এইরকম উল্লম্ফন স্পষ্টতই নিয়ন্ত্রক সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

বাজারের সামগ্রিক প্রভাব

শেয়ারবাজারে এ ধরনের ঘটনা বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করতে পারে। একাধিকবার অতীতে দেখা গেছে, কিছু কারসাজির কারণে বাজার বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। তাই এ ধরনের অস্বাভাবিক উত্থান বা পতনের ক্ষেত্রে দ্রুত এবং কঠোর পদক্ষেপ বাজার স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


উপসংহার

ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টসের শেয়ারের অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধি এবং লেনদেনের ভলিউম বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিএসইসি যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে, যা পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা বজায় রাখতে অপরিহার্য। বিনিয়োগকারীদেরও এই ধরনের অস্বাভাবিক উত্থানে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সচেতনতা ও সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।

ভবিষ্যতে যেন বাজারে সুস্থ প্রতিযোগিতা বজায় থাকে এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রতারণার শিকার না হন, সেটিই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button