বানিজ্য

এপ্রিলে ২৬ দিনে ২২৭ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা

চলতি বছরের এপ্রিল মাসের প্রথম ২৬ দিনে প্রবাসীরা বাংলাদেশে পাঠিয়েছেন ২২৭ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১২২ টাকা ধরে) এই অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৭০৬ কোটি টাকায়। প্রতিদিন গড়ে ৮ কোটি ৭৩ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে আসছে, যা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক বার্তা বহন করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়েছে, এপ্রিলের প্রথম ২৬ দিনে ২২৭ কোটি ১০ লাখ ৪০ হাজার মার্কিন ডলার দেশে এসেছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৮৫ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ১১ কোটি ৯৪ লাখ ১০ হাজার ডলার, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ১২৯ কোটি ৩৫ লাখ ৭০ হাজার ডলার এবং বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৪২ লাখ ৭০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স।

ব্যাংকভিত্তিক বিশ্লেষণ

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে প্রাপ্ত রেমিট্যান্সের অঙ্ক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এটি বোঝায় যে সরকার-নিয়ন্ত্রিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর প্রবাসীদের আস্থা এখনও সুসংহত। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে, যা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর সেবার মান এবং প্রবাসীদের প্রতি তাদের আকর্ষণীয় অফারগুলোর প্রতিফলন।

অন্যদিকে, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে প্রাপ্ত রেমিট্যান্সের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এটি স্পষ্ট করে যে প্রবাসীরা অধিকতর সুবিধা ও দ্রুততর লেনদেনের জন্য প্রাইভেট ব্যাংকগুলোর ওপর বেশি নির্ভর করছেন। বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে পাঠানো অর্থের পরিমাণ তুলনামূলক কম হলেও বৈচিত্র্যময় লেনদেন ব্যবস্থার একটি চিত্র তুলে ধরে।

সপ্তাহভিত্তিক রেমিট্যান্স প্রবাহ

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, এপ্রিল মাসের ২০ থেকে ২৬ তারিখের মধ্যে দেশে এসেছে ৫৫ কোটি ২৩ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স। এর আগের সপ্তাহে, অর্থাৎ ১৩ থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত এসেছে ৬৬ কোটি ৬৩ লাখ ৬০ হাজার ডলার।

এরও আগে, ৬ থেকে ১২ এপ্রিল সময়কালে দেশে এসেছে ৯৩ কোটি ৩১ লাখ ৮০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স, যা মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ সাপ্তাহিক সংগ্রহ। এপ্রিলের প্রথম পাঁচ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ১১ কোটি ৯১ লাখ ৯০ হাজার ডলার।

সাপ্তাহিক ভিত্তিতে এই প্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মাসের প্রথমভাগে রেমিট্যান্স প্রবাহ তুলনামূলক কম থাকলেও মাঝামাঝি সময়ে তা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ঈদুল ফিতরের মতো বড় ধর্মীয় উৎসবের প্রভাবও রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

মার্চ মাসের ঐতিহাসিক রেমিট্যান্স অর্জন

চলতি বছরের মার্চ মাসে বাংলাদেশ ইতিহাসের সর্বোচ্চ মাসিক রেমিট্যান্স অর্জন করেছে। মার্চে দেশে এসেছে ৩২৮ কোটি ৯৯ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪০ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা।

এর আগে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে, যার পরিমাণ ছিল প্রায় ২৬৪ কোটি ডলার। ফেব্রুয়ারিতে এসেছিল প্রায় ২৫৩ কোটি ডলার।

এই ধারাবাহিকতা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, প্রবাসীদের আস্থা ও দেশপ্রেম উভয়ই রেমিট্যান্স বৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে।

২০২৪ সালের রেমিট্যান্স চিত্র

সদ্য বিদায়ী ২০২৪ সালে বাংলাদেশে মোট রেমিট্যান্স এসেছিল ২ হাজার ৬৮৮ কোটি ৯১ লাখ মার্কিন ডলার। মাসভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়—

  • জানুয়ারি: ২১১ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার ডলার
  • ফেব্রুয়ারি: ২১৬ কোটি ৪৫ লাখ ৬০ হাজার ডলার
  • মার্চ: ১৯৯ কোটি ৭০ লাখ ৭০ হাজার ডলার
  • এপ্রিল: ২০৪ কোটি ৪২ লাখ ৩০ হাজার ডলার
  • মে: ২২৫ কোটি ৪৯ লাখ ৩০ হাজার ডলার
  • জুন: ২৫৩ কোটি ৮৬ লাখ ডলার
  • জুলাই: ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ ৭০ হাজার ডলার
  • আগস্ট: ২২২ কোটি ৪১ লাখ ৫০ হাজার ডলার
  • সেপ্টেম্বর: ২৪০ কোটি ৪৭ লাখ ৯০ হাজার ডলার
  • অক্টোবর: ২৩৯ কোটি ৫০ লাখ ৮ হাজার ডলার
  • নভেম্বর: ২১৯ কোটি ৯৫ লাখ ১০ হাজার ডলার
  • ডিসেম্বর: ২৬৩ কোটি ৮৭ লাখ ৮০ হাজার ডলার

বছরব্যাপী এই ধারাবাহিক রেমিট্যান্স প্রবাহ দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

অর্থনীতিতে প্রবাসী আয়ের অবদান

রেমিট্যান্স বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমৃদ্ধ করতে একটি বড় অনুঘটক। এটি কেবল রিজার্ভ বৃদ্ধিতেই ভূমিকা রাখছে না, বরং গ্রামীণ অর্থনীতিতেও প্রাণ সঞ্চার করছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, রেমিট্যান্স প্রবাহের ফলে দেশের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, দারিদ্র্যের হার কমছে এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তির হার বাড়ছে। ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে প্রবাসী আয় আসার হার বাড়াতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক যৌথভাবে নানা উদ্যোগ নিয়েছে, যার সুফল এখন দৃশ্যমান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদনে এই ইতিবাচক প্রবণতার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে, যদি এই গতি অব্যাহত থাকে, তবে বাংলাদেশের বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি আরও শক্তিশালী হবে।

ভবিষ্যতের প্রত্যাশা

বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবেশ কিছুটা প্রতিকূল হলেও প্রবাসী আয়ের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এটি বড় সহায়ক হবে।

বিশেষ করে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকারের নানা উদ্দীপক প্যাকেজ, স্বল্প ফি সুবিধা, এবং নিরাপদ লেনদেন ব্যবস্থার উন্নয়ন ভবিষ্যতে এই খাতে আরও ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

বর্তমানে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশি প্রবাসী কর্মীর সংখ্যা বাড়ছে। সেই সাথে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হচ্ছে। এসব কারণেই সামনের দিনগুলোতেও রেমিট্যান্স প্রবাহ ইতিবাচক থাকবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button