ইরানে ইসরায়েলি হামলা জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন, মধ্যস্থতার প্রস্তাব পুতিনের

মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল ও উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ফলে এই অঞ্চল আবারও সামরিক সংঘর্ষ ও উত্তেজনার মূল কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। একদিকে যেমন ইরানের প্রতিক্রিয়া তীব্র, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মহলে এই হামলাকে জাতিসংঘের সনদ লঙ্ঘন হিসেবে কঠোর নিন্দা জানানো হয়েছে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, যিনি ভূ-রাজনৈতিক সংকটে মধ্যস্থতার জন্য বেশ পরিচিত, এই ঘটনা নিয়ে সরাসরি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি ইসরায়েলের হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছেন। একই সঙ্গে, তিনি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানকে পৃথক ফোনালাপে সতর্ক করেছেন।
ইরানের ওপর ইসরায়েলের হামলা: জাতিসংঘ সনদের স্পষ্ট লঙ্ঘন
ইসরায়েলের সাম্প্রতিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলাটি আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের স্পষ্ট লঙ্ঘন বলে ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন জোর দিয়ে বলেছেন, “একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের ওপর বিনা উসকানিতে আক্রমণ এবং তার শান্তিপূর্ণ নাগরিক ও পারমাণবিক স্থাপনা লক্ষ্যবস্তু করা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।”
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই হামলা শুধু আঞ্চলিক নয়, বৈশ্বিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও বড় হুমকি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এই ধরনের আগ্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও পুতিনের মধ্যস্থতা প্রস্তাব
ক্রেমলিন সূত্রে জানা গেছে, পুতিন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে ফোনালাপে বলেন, তিনি উত্তেজনা বাড়ানো থেকে বিরত থাকতে চান এবং সমাধানের জন্য রাশিয়া মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত। একই সময়ে তিনি ইরানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও কথা বলেছেন, শান্তি প্রতিষ্ঠায় দ্বিপক্ষীয় সংলাপের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন।
ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, পুতিন এই উত্তেজনাময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “পুরো অঞ্চলের জন্য এই সংঘাত ভয়াবহ পরিণতির কারণ হতে পারে।”
মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা: রাশিয়ার সতর্কতা ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা
উত্তেজনার অবসান না হওয়ায় রাশিয়া তার নাগরিকদের জন্য মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল ভ্রমণে বিশেষ সতর্কতা জারি করেছে। রাশিয়ার দূতাবাসগুলো, বিশেষ করে ইসরায়েল, ইরান ও মিশরে, নাগরিকদের বিপদ এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছে। যারা ইতিমধ্যে ওইসব দেশে অবস্থান করছেন, তাদের দ্রুত নিরাপদে ফিরে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, রাশিয়ার বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা রোসাভিয়াশিয়া ২৬ জুন পর্যন্ত ইসরায়েল, ইরাক, ইরান ও জর্ডানের আকাশসীমায় দেশীয় বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করেছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে রাশিয়ার বৃহৎ বিমান সংস্থাগুলো মধ্যপ্রাচ্যের ফ্লাইট বাতিল ও রুট পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছে।
ইরানের প্রতিক্রিয়া ও পারমাণবিক কর্মসূচি
ইরানের পক্ষ থেকে এই হামলার তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দায়িত্বশীল পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানানো হয়েছে। ইরান বারবার দাবি করেছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে এবং যে কোনো আক্রমণ তাদের সার্বভৌমত্বের প্রতি স্পষ্ট অবজ্ঞা।
আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) ইতিমধ্যে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ও কার্যক্রম সম্পর্কে নজরদারি জোরদার করেছে। এই হামলার প্রেক্ষিতে আইএইএ বোর্ড অব গভর্নরসের চলমান আলোচনা ও ইরান-যুক্তরাষ্ট্র পরোক্ষ সংলাপের মধ্যে এমন একটি সংকট আরো কঠিন অবস্থায় ফেলেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের সংকট: বড় আন্তর্জাতিক প্রভাব ও সম্ভাব্য পরিণতি
মধ্যপ্রাচ্যের এই সাম্প্রতিক সংঘর্ষ শুধু ওই অঞ্চলের সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি বিশ্ব রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বের জেরে, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীনসহ বৃহৎ শক্তিগুলো নতুন কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের সামরিক উত্তেজনা গ্যাস ও তেলের সরবরাহে বিঘ্ন ঘটিয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে। এর পাশাপাশি, মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ভূমিকা আগের থেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।