উন্নত ব্যবসায়িক পরিবেশ চান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা

বিশ্বব্যাপী ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। এর ফলে দেশের ব্যবসায়িক পরিবেশে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা (এসএমই) পড়েছেন নানা চ্যালেঞ্জের মুখে। তাঁরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, ব্যবসায়িক হয়রানি, ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহার, কর ও ভ্যাট ব্যবস্থার জটিলতা এবং যানজটের কারণে ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। একই সঙ্গে তাঁরা দাবি জানিয়েছেন সহজ ও স্বচ্ছ ভ্যাট ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপদ, পূর্বানুমানযোগ্য ব্যবসায়িক পরিবেশ গড়ে তোলার।
মতবিনিময় সভায় ব্যবসায়ীদের অভিমত
গতকাল শনিবার রাজধানীর একটি কনভেনশন সেন্টারে আয়োজিত ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, আইনশৃঙ্খলা, আয়কর ও ভ্যাট, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ সুদহার এবং যানজট নিয়ে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এসব দাবি ওঠে। সভার আয়োজন করে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)।
এতে ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর এবং আদাবর এলাকার ১০টি ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। তাঁরা সরাসরি তাঁদের সমস্যা ও করণীয় সম্পর্কে মতামত তুলে ধরেন।
সমস্যা কোথায়?
ব্যবসায়ীদের বক্তব্য অনুযায়ী, বর্তমানে ব্যবসা পরিচালনায় যেসব সমস্যা সবচেয়ে প্রকট:
- আইনশৃঙ্খলার অবনতি: ব্যবসায়িক স্থিতিশীলতার জন্য শান্তিপূর্ণ পরিবেশ অপরিহার্য। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন এলাকায় নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ছে।
- ব্যবসায়িক হয়রানি: প্রশাসনিক জটিলতা ও অকারণ হয়রানির অভিযোগ বেড়েছে, যা বিনিয়োগের মনোভাব নষ্ট করছে।
- ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহার: উদ্যোক্তারা বলছেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গেলে সুদের হার এতটাই বেশি যে, তা ব্যবসার টিকে থাকার জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
- কর ও ভ্যাট ব্যবস্থার জটিলতা: দীর্ঘসূত্রতা ও জটিল নিয়মনীতি ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত সময় ও অর্থ ব্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
- যানজট: রাজধানীতে যানজটের কারণে পণ্য পরিবহন ব্যয় ও সময় দুটোই বেড়েছে।
এসব কারণেই ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগ করতে দ্বিধাগ্রস্ত এবং ব্যবসা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রেও পিছিয়ে যাচ্ছেন।
ডিসিসিআই সভাপতির বক্তব্য
ডিসিসিআই সভাপতি তাসকীন আহমেদ সভায় বলেন, “কর ও ভ্যাট ব্যবস্থার জটিলতা, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, আমদানি-রপ্তানিতে দীর্ঘসূত্রতা এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি—এসব মিলিয়ে দেশের এসএমই খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমানে একটি নিরাপদ, স্থিতিশীল ও পূর্বানুমানযোগ্য ব্যবসায়িক পরিবেশ গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।”
তিনি আরও বলেন, এসএমই খাতের বিকাশ ছাড়া দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা কঠিন হবে। তাই সরকার ও নীতিনির্ধারকদের উচিত এসএমই উদ্যোক্তাদের সমস্যা সমাধানে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।
বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ
বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান সভায় জানান, এসএমই উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা সহজ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন:
- মেয়াদি ঋণের সময়সীমা পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে সাত বছর করা হয়েছে।
- কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের আওতায় এসএমই উদ্যোক্তারা সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ সুদে ঋণ পাচ্ছেন।
- নারী উদ্যোক্তারা পাচ্ছেন মাত্র ৫ শতাংশ সুদে ঋণের সুবিধা।
এসব উদ্যোগের ফলে এসএমই খাতের উদ্যোক্তারা সহজ শর্তে ঋণ গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছেন, যা তাঁদের ব্যবসা সম্প্রসারণ ও টিকে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা।
ভ্যাট ব্যবস্থার সহজীকরণ উদ্যোগ
ভ্যাট কমিশনারেট ঢাকা পশ্চিমের অতিরিক্ত কমিশনার মো. মিলন শেখ সভায় বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ রাজস্ব আদায় করে। তিনি জানান, ব্যবসায়ীদের ভ্যাট প্রদান প্রক্রিয়া সহজ ও আধুনিক করতে মোবাইল অ্যাপ চালুর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এতে করে ভ্যাট সংক্রান্ত কাজ আরও সহজ, দ্রুত এবং স্বচ্ছ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ব্যবসায়ীদেরও সচেতন হতে হবে এবং নিয়মিতভাবে কর ও ভ্যাট প্রদানে এগিয়ে আসতে হবে।
কী চাইছেন উদ্যোক্তারা?
সভায় অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীরা কয়েকটি মূল দাবি তুলে ধরেছেন:
- সহজ ও স্বচ্ছ ভ্যাট ব্যবস্থাপনা
- ব্যবসায়িক হয়রানি বন্ধ করা
- ব্যাংক ঋণের সুদহার যৌক্তিক করা
- যানজট কমাতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ
- ব্যবসায়িক নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা জোরদার করা
- আমদানি-রপ্তানির প্রক্রিয়া সহজীকরণ
- ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ
তাঁরা বলেন, এসব দাবি বাস্তবায়িত হলে এসএমই খাত আরও মজবুত হবে এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে।
বিশ্বব্যাপী অনিশ্চয়তা ও দেশের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের মধ্যে বাংলাদেশের এসএমই খাত টিকে থাকার জন্য লড়াই করছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা উন্নত, নিরাপদ ও স্থিতিশীল ব্যবসায়িক পরিবেশ চান, যাতে তাঁরা বিনিয়োগ বাড়াতে ও কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারেন। সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া নানা উদ্যোগ আশার আলো দেখালেও বাস্তবায়নের গতি আরও বাড়ানো জরুরি।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সমস্যা দূর করতে এখন প্রয়োজন সরকার, ব্যাংক এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে সমন্বিত প্রচেষ্টা। তবেই গড়ে উঠবে একটি উন্নত, শক্তিশালী ও টেকসই এসএমই খাত, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে হবে অন্যতম চালিকাশক্তি।