বানিজ্য

প্রথম প্রান্তিকে লোকসানের ধাক্কায় সিঙ্গার, বাড়লো ক্ষতির পরিমাণ

চলতি হিসাব বছরের প্রথম প্রান্তিকে বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়েছে বহুজাতিক কোম্পানি সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড। চলতি বছরের (২০২৫) জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান (ইপিএস) দাঁড়িয়েছে ৩ টাকা ৫০ পয়সা। অথচ গত বছরের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল মাত্র ২১ পয়সা। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে লোকসানের হার বেড়েছে প্রায় ১৫৫৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ

প্রথম প্রান্তিকের আর্থিক চিত্র

সিঙ্গার বাংলাদেশ ৩১ মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত সময়ের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থা আরও দুর্বল হয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) অনুষ্ঠিত পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে প্রতিবেদনটি অনুমোদনের পর প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায়, চলতি প্রান্তিকে সিঙ্গারের শেয়ারপ্রতি নগদ অর্থপ্রবাহ (এনওসিএফপিএস) দাঁড়িয়েছে ৪ টাকা ৭৯ পয়সা। আগের বছর একই সময়ে নগদ অর্থপ্রবাহ ছিল মাইনাস ৩ টাকা ৮৪ পয়সা। অর্থাৎ, অপারেটিং কার্যক্রম থেকে অর্থপ্রবাহ কিছুটা ইতিবাচক হলেও সামগ্রিকভাবে আয় কমে গেছে।

নিট সম্পদমূল্যের পতন

প্রথম প্রান্তিক শেষে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে ২১ টাকা ৩১ পয়সা। অথচ ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে এনএভিপিএস ছিল ২৫ টাকা ৮১ পয়সা। অর্থাৎ নিট সম্পদের পরিমাণও কমেছে।

পূর্ববর্তী বছরের আর্থিক চিত্র

২০২৪ হিসাব বছরের জন্য সিঙ্গার বাংলাদেশ শেয়ারহোল্ডারদের ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে, যদিও ওই বছরের শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছিল ৪ টাকা ৯১ পয়সা। তারও আগে, ২০২৩ সালে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা ছিল ৫ টাকা ২৪ পয়সা। এ থেকে স্পষ্ট, কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থা ধারাবাহিকভাবে খারাপের দিকে যাচ্ছে।

লোকসানের মূল কারণ

কোম্পানির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরের (২০২৪) আর্থিক দুরবস্থার মূল কারণ ছিল:

  • ব্যাংকঋণের সুদহার বৃদ্ধি:
    ২০২৩ সালে যেখানে অর্থায়ন ব্যয় ছিল ৬০ কোটি ৪০ লাখ টাকা, ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৪৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা। অর্থাৎ সুদের বোঝা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে।
  • টাকার বিনিময় হার কমে যাওয়া:
    ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের ফলে কোম্পানিটি ২৪ কোটি ৭০ লাখ টাকার ক্ষতি গুনতে হয়েছে।

শেয়ারবাজারে সিঙ্গারের অবস্থান

গত এক বছরে সিঙ্গারের শেয়ারের সর্বোচ্চ দাম ছিল ১৫৪ টাকা ৮০ পয়সা এবং সর্বনিম্ন ছিল ৯৬ টাকা ৮০ পয়সা। দামের এ ওঠানামা কোম্পানির আর্থিক অনিশ্চয়তার প্রতিফলন হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

পূর্ববর্তী বছরগুলোতে সিঙ্গার যে হারে নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে, তা হলো:

  • ২০২৩ সালে: ৩৫ শতাংশ
  • ২০২২ সালে: ১০ শতাংশ
  • ২০২১ সালে: ৬০ শতাংশ
  • ২০২০ সালে: ৩০ শতাংশ

এ থেকে বোঝা যায়, সিঙ্গার আগে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য লাভজনক কোম্পানি ছিল, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও চ্যালেঞ্জ

বর্তমানে উচ্চ সুদের হার এবং বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিরতা সিঙ্গারসহ দেশের অন্যান্য আমদানি নির্ভর কোম্পানির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি সুদের হার কমানো না হয় এবং মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল না হয়, তবে সিঙ্গারসহ অনেক কোম্পানির জন্য লাভের ধারায় ফেরা কঠিন হবে।

এছাড়া উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনা, বিক্রয় নেটওয়ার্ক আরও সম্প্রসারণ, অনলাইন বিক্রিতে গুরুত্ব দেওয়া এবং অপারেটিং খরচ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সিঙ্গার বাংলাদেশ ফের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে পারে।

সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড দেশের অন্যতম পরিচিত ব্র্যান্ড হলেও, সাম্প্রতিক আর্থিক প্রতিবেদনের পর স্পষ্ট যে কোম্পানিটি চরম সংকটে রয়েছে। ক্রমবর্ধমান অর্থায়ন ব্যয়, বৈদেশিক মুদ্রা ক্ষতি এবং কম বিক্রির চাপে লোকসান দিন দিন বাড়ছে। যথাযথ কৌশল ও ব্যয় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে যদি পরিস্থিতি মোকাবেলা করা না যায়, তাহলে কোম্পানির ভবিষ্যৎ আরও সংকটাপন্ন হতে পারে।

শেয়ারহোল্ডার এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য এখন প্রয়োজন সতর্ক দৃষ্টিতে কোম্পানির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা এবং বাজারের পরিবর্তন অনুযায়ী বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেওয়া।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button