বানিজ্য

তেলের দামে পতন, ভূরাজনীতির প্রভাব স্পষ্ট

বিশ্ববাজারে আবারও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে জ্বালানি তেলের দামে। ওপেক প্লাস জোটের সম্ভাব্য উৎপাদন বৃদ্ধির ইঙ্গিত এবং ভূরাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুর প্রভাবে বুধবার আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দর প্রায় ২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে শুল্ক কমানো নিয়ে আলোচনার আভাস কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরিয়েছে বাজারে।

কেন কমছে তেলের দাম?

তেলের দামে এই পতনের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে ওপেক প্লাস জোটের উৎপাদন বৃদ্ধির সম্ভাবনাকে। বিশ্বের প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর এই জোটের একাধিক সদস্য আগামী জুন মাস থেকে উৎপাদন বাড়ানোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এটি হবে টানা দ্বিতীয় মাসের জন্য উৎপাদন বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত।

বিশ্লেষকদের মতে, বাজারে তেলের সরবরাহ বাড়বে এমন আশঙ্কা থেকেই বিনিয়োগকারীরা বিক্রির দিকে ঝুঁকছেন, যার ফলে তেলের দর কমছে।

গতকাল কতটা কমেছে দাম?

রয়টার্সের তথ্যমতে, বুধবার ব্রেন্ট ক্রুড ফিউচার্সের দাম ব্যারেলপ্রতি কমেছে ১.৩২ ডলার বা ১.৯৬ শতাংশ। বিক্রি হয়েছে ৬৬.১২ ডলারে। অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (WTI) ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ১.৪০ ডলার বা ২.২ শতাংশ হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৬২.২৭ ডলারে

তবে দিনের শুরুতে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ৬৮.৬৫ ডলার পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল, যা ছিল গত ৪ এপ্রিলের পর সর্বোচ্চ।

ওপেক প্লাস কী বলছে?

ওপেক প্লাসের আলোচনা সম্পর্কে অবগত একাধিক সূত্র জানায়, জুন থেকে উৎপাদন বাড়ানোর প্রস্তাব আসতে পারে। যদিও এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত নয়, তবুও আলোচনা থেকেই বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

প্রাইস ফিউচার্স গ্রুপের বিশ্লেষক ফিল ফ্লিন বলেন, ‘আমি অবাক হব না যদি ওপেক উৎপাদন বাড়ায়। জোটের মধ্যে সংহতির অভাব এর একটি কারণ হতে পারে।’ তিনি মনে করেন, উৎপাদন হ্রাসে ওপেক প্লাস হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

কাজাখস্তানের ভূমিকা

ওপেক প্লাসের সদস্য না হলেও গুরুত্বপূর্ণ মিত্র দেশ কাজাখস্তান সম্প্রতি নির্ধারিত কোটার চেয়ে বেশি তেল উৎপাদন করে জোটের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করেছে। এরপর কাজাখ জ্বালানি মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, তারা ‘আন্তর্জাতিক জ্বালানি সম্প্রদায়ের দায়িত্বশীল অংশীদার’ হিসেবে কাজ করতে আগ্রহী এবং বাজারে ভারসাম্য রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

তবে এর পরও সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কাজাখস্তান নিজের জাতীয় স্বার্থকে ওপেক প্লাস চুক্তির চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের মজুত ও শুল্ক-সংক্রান্ত খবর

তেলের বাজারে মিশ্র প্রভাব ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তথ্য। গত সপ্তাহে দেশটির অপরিশোধিত তেলের মজুত অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়েছে। তবে পেট্রোল ও ডিস্টিলেট (বিশেষ ধরনের পরিশোধিত তেল) মজুত প্রত্যাশার চেয়ে কমেছে।

বাইসন ইন্টারেস্টসের প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা জশ ইয়াং বলেন, ‘মজুত বৃদ্ধির মৌসুমেও তেলের পণ্যের মজুত কমছে—এটি বাজারে দর বাড়ানোর ইঙ্গিত হতে পারে।’ তবে তিনি স্বীকার করেন, ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতি এবং সম্ভাব্য চাহিদা হ্রাসের প্রভাব এখনো পুরোমাত্রায় বাজারে দেখা যাচ্ছে না।

ট্রাম্পের শুল্ক কমানোর আলোচনা

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের সঙ্গে বাণিজ্য উত্তেজনা কমাতে চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক কমানোর চিন্তাভাবনা করছেন বলে খবর দিয়েছে রয়টার্স ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। সূত্র বলছে, আমদানিকৃত চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক ৫০ থেকে ৬৫ শতাংশ এর মধ্যে নামিয়ে আনার বিষয়টি বিবেচনা করছে হোয়াইট হাউস।

এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট বলেছেন, চীনের সঙ্গে আলোচনার আগে দুই দেশের মধ্যে অতিরিক্ত উচ্চ শুল্ক কমাতে হবে।

এই খবরে বিশ্ববাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে স্বস্তি ফেরে এবং তেলের দামের পতন কিছুটা রোধ হয়।

ভবিষ্যতে তেলের বাজার কোন দিকে যাবে?

বিশ্লেষকদের মতে, আগামী কয়েক সপ্তাহে ওপেক প্লাসের সিদ্ধান্ত, যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য আলোচনা এবং ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা—এই তিনটি বিষয় তেলের দামে বড় ভূমিকা রাখবে।

বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ধীরগতি হওয়ায় চাহিদা পূর্বাভাস অনিশ্চিত। তার ওপর উৎপাদন বাড়লে সরবরাহে উদ্বৃত্ত তৈরি হতে পারে, যা দাম আরও কমিয়ে দিতে পারে।

বাংলাদেশের জন্য প্রভাব

বিশ্ববাজারে তেলের দামের এই ধস বাংলাদেশের জন্য মিশ্র বার্তা বহন করে। আমদানিনির্ভর অর্থনীতির কারণে সরকার কিছুটা স্বস্তি পেলেও অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতির চাপ এখনো কাটেনি। তবে আমদানি ব্যয় কমলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা সহজ হবে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশ সরকার যদি এই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল কিনে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করে, তাহলে ভবিষ্যতের জন্য এটি লাভজনক হতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button