পাঁচতলা বাড়ির মালিকও টিসিবির কার্ড পেয়েছিলেন, বাণিজ্য উপদেষ্টা

সরকারি ভর্তুকির পণ্য পেতে টিসিবির (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) ফ্যামিলি কার্ড কার্যক্রম চালু হলেও তা কতটা সঠিকভাবে পরিচালিত হয়েছে, তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, পাঁচতলা বাড়ির মালিক এমনকি প্রশাসনের কর্মকর্তার পরিবারেও একাধিক কার্ড ছিল—এমন তথ্য জানিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।
আজ বুধবার (২৩ এপ্রিল) ঢাকার আর্মি গলফ ক্লাবের গলফ গার্ডেনে আয়োজিত ‘টিসিবির সঙ্গে বাণিজ্য’ শীর্ষক সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এই অনিয়মের চিত্র তুলে ধরেন।
টিসিবি কার্ড বিতরণে বিশাল অনিয়ম: একজনের বাড়িতে তিনটি কার্ড!
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন,
“দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে দেখা গেছে—পাঁচতলা বাড়ির মালিকও টিসিবির কার্ড পেয়েছেন। এমনকি প্রশাসনে থাকা এক ব্যক্তির পরিবারে তিনটি কার্ড পাওয়া গেছে।”
তিনি বলেন, এক কোটি ফ্যামিলি কার্ড বিতরণের সময় ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছিল। কার্ড তৈরির এই প্রক্রিয়ায় যারা প্রকৃত অর্থে সুবিধাভোগী ছিলেন না, তারাই অধিকহারে কার্ড পেয়েছেন। অন্যদিকে, প্রকৃত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অনেকেই বাদ পড়েছেন।
‘দুর্বৃত্তায়নের’ শিকার টিসিবি: আগের পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরলেন উপদেষ্টা
শেখ বশিরউদ্দীন বলেন,
“আগস্ট বিপ্লবের আগেই টিসিবি দুর্বৃত্তদের হাতে চলে গিয়েছিল। তারা যেনতেনভাবে কার্ড বিতরণ করেছে। কার্ড পেতে হলে কারও তদবির, কারও কমিশন লাগতো। আমরা এই দুর্বৃত্তায়িত ব্যবস্থাকে ভেঙে দিতে চাই।”
তিনি আরও বলেন,
“সরকারি ব্যবস্থাপনার ওপর আস্থা তখনই আসবে, যখন মানুষ দেখবে দুর্নীতি নেই, স্বচ্ছতা আছে। টিসিবিকে সেই স্বচ্ছতার জায়গায় নিতে হবে।”
অনিয়ম চিহ্নিত করে কমানো হয়েছে ৪০ লাখ কার্ড
বাণিজ্য উপদেষ্টা জানান, ইতোমধ্যে অনিয়ম খতিয়ে দেখে প্রায় ৪০ লাখ কার্ড বাদ দেওয়া হয়েছে।
“আমরা নির্ধারণ করেছি, এখন থেকে শুধু নিম্ন আয়ের প্রকৃত উপযুক্ত পরিবারগুলোই টিসিবির কার্ড পাবে। তাতে সরকারের ভর্তুকির পণ্য সঠিকভাবে মানুষের কাছে পৌঁছাবে।”
টিসিবির ভর্তুকি: ৬-৭ হাজার কোটি টাকা লোকসান
প্রতিবছর টিসিবির মাধ্যমে যেসব পণ্য কেনাবেচা হয়, তার বাজারমূল্য প্রায় ১২ থেকে ১৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারকেই দিতে হয় ৬ থেকে ৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি।
এই বিশাল অঙ্কের ভর্তুকি যদি প্রকৃত সুবিধাভোগীদের হাতে না পৌঁছে বরং মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্তদের কার্ডের পেছনে চলে যায়—তাহলে সেই অর্থ দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
নতুন দৃষ্টিভঙ্গি: কার্ডে পণ্য নয়, আসছে ডিজিটাল যাচাই ব্যবস্থা
টিসিবি সূত্র জানিয়েছে, ভবিষ্যতে জাতীয় পরিচয়পত্রের ভিত্তিতে ডিজিটাল যাচাই করে ফ্যামিলি কার্ড প্রদান করা হবে। এতে করে কার্ডধারীদের আর্থিক অবস্থা যাচাই করা সহজ হবে এবং ভুয়া কিংবা অপ্রয়োজনীয় ভর্তুকি এড়ানো যাবে।
টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ ফয়সল আজাদ বলেন,
“আমরা একটি পূর্ণাঙ্গ যাচাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে টিসিবি কার্ড প্রাপ্যতা নির্ধারণে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে কার্ডধারীদের শুধু চাল, ডাল, তেল, চিনি নয়—সাবান ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীও দেয়া হবে।”
টিসিবির অনুষ্ঠান: গবেষণা ও আলোচনায় উঠল সমাধানের পথ
‘কোটি মানুষের পাশে’ শীর্ষক এই সংলাপে টিসিবির দুই পরিচালক এস এম শাহীন পারভেজ ও আবেদ আলী এবং যুগ্ম পরিচালক আল আমিন হাওলাদার তিনটি গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। পরে মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন ছাত্র প্রতিনিধি ও ব্যবসায়ীরা।
প্রবন্ধে উঠে আসে—টিসিবি কার্যক্রমে জনসম্পৃক্ততা, দুর্নীতি রোধে স্বচ্ছতা এবং ভর্তুকির যথাযথ ব্যবহার কীভাবে নিশ্চিত করা যায়।
অনুষ্ঠানে টিসিবির চেয়ারম্যান ফয়সল আজাদ স্বাগত বক্তব্য দেন এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী সমাপনী বক্তব্যে বলেন,
“যখন দুর্নীতির পরিবর্তে জবাবদিহিতা আসে, তখনই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আস্থা ফিরে আসে।”
জনগণের প্রত্যাশা: প্রকৃত দরিদ্রদের হাতে ভর্তুকি পৌঁছাক
টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড মূলত চাল, ডাল, তেল, চিনি ইত্যাদি ভর্তুকি মূল্যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হাতে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে চালু করা হয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন পর্যায়ের অনিয়ম ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে প্রকৃত উপকারভোগীরা এই সহায়তা থেকে বঞ্চিত হন।
এখন সরকারের পক্ষ থেকে যে স্বচ্ছতার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তা যদি বাস্তবায়ন করা যায়, তবে দরিদ্র জনগণের জন্য এটি হবে এক বড় ধরনের সহায়তা।
টিসিবির শুদ্ধিকরণে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ জরুরি
টিসিবিকে দুর্নীতি, অনিয়ম ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে সরকারের যে পদক্ষেপ, তা প্রশংসনীয়। তবে এই উদ্যোগ যেন কেবল ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ না করলে দুর্বৃত্তায়ন আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশে টিসিবি একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। এর কার্যক্রম যদি প্রকৃত দারিদ্র্য বিমোচনের দিকে নির্দেশিত হয়, তবে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা নীতিও শক্তিশালী হবে।