এলএনজি সরবরাহে চুক্তি নবায়ন করবে কাতার

বাংলাদেশের জন্য তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ নিশ্চিত করতে পুনরায় সক্রিয় হচ্ছে কাতার। সম্প্রতি মেয়াদোত্তীর্ণ সমঝোতা স্মারক (MoU) নবায়নের পাশাপাশি বাংলাদেশে একটি স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের কারিগরি সহযোগিতাও দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে দেশটি।
মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) কাতারের রাজধানী দোহায় অনুষ্ঠিত ‘আর্থনা শীর্ষ সম্মেলন’-এর ফাঁকে কাতারের জ্বালানি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সাদ বিন শেরিদা আল কাবি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওই সাক্ষাতে তিনি বাংলাদেশের প্রতি কাতারের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।
প্রতিমন্ত্রী আল কাবি বলেন, “আমরা বাংলাদেশকে যতটা সম্ভব সমর্থন করতে চাই এবং এটি আমরা অব্যাহত রাখব।” তিনি আরও জানান, এলএনজি সরবরাহে দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারিত্ব কাতারের কৌশলগত লক্ষ্য এবং বাংলাদেশকে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহের জন্য তার দেশ অঙ্গীকারাবদ্ধ।
পুরোনো চুক্তির নবায়ন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে সরকার-থেকে-সরকার ভিত্তিক (জিটুজি) একটি বিক্রয়-ক্রয় চুক্তি (Sales and Purchase Agreement – SPA) স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির আওতায় কাতার গ্যাস বাংলাদেশকে প্রতি বছর ১.৫ থেকে ২.৫ মেট্রিক টন এলএনজি সরবরাহ করে আসছে। এতে বার্ষিক প্রায় ৪০টি এলএনজি কার্গো দেশে আসে।
২০২৩ সালের জুনে দ্বিতীয় আরেকটি এলএনজি এসপিএ স্বাক্ষরিত হয়, যার মাধ্যমে ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে আরও ১.৫ মেট্রিক টন এলএনজি সরবরাহ শুরু হবে।
তবে এই দুটি SPA-র ভিত্তিতে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের মেয়াদ ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে শেষ হয়ে যায়। ফলে চুক্তির ধারাবাহিকতা রক্ষায় নতুন করে একটি সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রয়োজন দেখা দেয়। মঙ্গলবারের বৈঠকে কাতারি প্রতিমন্ত্রী নিশ্চিত করেন, তারা শীঘ্রই এই MoU নবায়ন করবেন।
স্থলভিত্তিক টার্মিনালের পরিকল্পনা
বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বৈঠকে জানান, বাংলাদেশ কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে একটি স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। এটি হবে দেশের প্রথম স্থলভিত্তিক এলএনজি সুবিধা, যেখানে সরাসরি গ্যাস আনলোড, রিগ্যাসিফিকেশন ও পাইপলাইনের মাধ্যমে বিতরণের ব্যবস্থা থাকবে।
এই টার্মিনাল নির্মাণের মাধ্যমে এলএনজি সরবরাহে নির্ভরযোগ্যতা বাড়বে এবং বর্তমান ভাসমান টার্মিনালগুলোর উপর চাপ কমবে। বর্তমানে বাংলাদেশের দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল (FSRU) বছরে সর্বোচ্চ ১১৫টি এলএনজি কার্গো পরিচালনা করতে সক্ষম। স্থলভিত্তিক টার্মিনালটি চালু হলে এই সক্ষমতা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে।
অংশীদারিত্বের ভবিষ্যৎ ও দামের সম্ভাব্য প্রভাব
কাতারের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেন, “আমরা আমাদের এলএনজি উৎপাদন দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা নিয়েছি। এতে বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম কমে আসবে বলে আশা করছি। এ ধরনের পরিস্থিতিতে দীর্ঘমেয়াদি SPA-ই সরবরাহ নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে কার্যকর পন্থা।”
বিশ্ববাজারে এলএনজির অস্থির দাম এবং সরবরাহে অনিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও, দীর্ঘমেয়াদি SPA চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ সাশ্রয়ী মূল্যে এবং নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ পেতে পারে। কাতার এমন একটি উৎস, যাদের এলএনজি উৎপাদনে দক্ষতা এবং অবকাঠামো রয়েছে, যা বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদা পূরণে সহায়ক হবে।
ইউরিয়া সার রপ্তানির প্রস্তাব
এলএনজি সরবরাহ ছাড়াও, বৈঠকে কাতার বাংলাদেশে ইউরিয়া সার রপ্তানি বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। কাতারের প্রতিমন্ত্রী জানান, “আমরা বাংলাদেশে ইউরিয়া সার রপ্তানির সুযোগ ও চাহিদা নিয়ে কাজ করছি। আমাদের যৌথভাবে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।”
বাংলাদেশের কৃষিখাতে ইউরিয়া সারের চাহিদা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে এবং বিদেশ থেকে আমদানি করে এই চাহিদা পূরণ করতে হয়। কাতারের প্রস্তাব এই আমদানিকে আরও সাশ্রয়ী ও নিরবচ্ছিন্ন করতে পারে।
উচ্চ পর্যায়ের উপস্থিতি
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক মাহমুদ, প্রধান উপদেষ্টার এসডিজি বিষয়ক সচিব লামিয়া মোরশেদ এবং জ্বালানি সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস কাতারের প্রতিমন্ত্রীকে বলেন, “বাংলাদেশের জ্বালানি খাত পুনর্গঠনে আমরা কাতারের সহযোগিতা চাই। আমাদের সম্ভাবনাগুলো একসঙ্গে অনুসন্ধান করতে চাই।”
উপসংহার
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাতারের সঙ্গে নবায়িত চুক্তি এবং সম্ভাব্য নতুন এলএনজি অবকাঠামো গড়ে তোলার পরিকল্পনা এই নিরাপত্তাকে একটি মজবুত ভিত্তি দিতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদে, কাতারের সহযোগিতায় কেবল এলএনজি নয়, ইউরিয়া সারসহ আরও খাতে দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্ব গড়ে উঠতে পারে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এই ধরনের কৌশলগত অংশীদারিত্ব বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।